এতক্ষণ যা যা লিখেছি তা থেকে নিশ্চয়ই আমার স্বপ্ন তথা দুঃস্বপ্নগুলো কতখানি ভয়ানক ছিল তা বোঝা গেছে। ইতিমধ্যে আমি বেশ টের পাচ্ছিলাম যে, বদ্ধপাগল হবার প্রাথমিক ধাপে আমি প্রবেশ করে ফেলেছি। মাঝে মাঝে ভাবতাম, আমার আগে যারা এই ঘটনার শিকার হয়েছে, তারাও কি এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল? কে জানে! একদিকে এই সচেতন আর অবচেতন মন যুদ্ধ চালাত, আর অন্যদিকে আমার মগজে এইসব বিদঘুটে ভাবনা পাকাপাকি জায়গা দখল করে বসেছিল। ওহ্ একটা কথা বলাই হয়নি। আমার ওই উপকথার থিয়োরিগুলো কিন্তু ইতিমধ্যে স্বীকৃতির তকমা পেয়েছিল। এমনকী ভিনগ্রহীদের মতবাদে বিশ্বাসীরাও আগে ঘটে-যাওয়া অনেক কেসের হদিশ দিয়ে আমাকে বিস্তর সাহায্য করেছিলেন। সব থেকে আনন্দদায়ক বিষয় হল, তাঁরা আমাকে পাগল তো বলেনইনি, বরং এটাকে সাময়িকভাবে স্নায়ুবৈকল্যের উপসর্গই বলেছিলেন। আমার কাজ ছিল শুধু তথ্যসংগ্রহ আর বিশ্লেষণ আর ওঁদের কাজ ছিল মনোবিজ্ঞানের আলোকে সেগুলোর ভুল সংশোধন। এমনকী কিছু ডাক্তার তো আমার আর আমার ওই দ্বৈত সত্তার ওপর রীতিমতো পড়াশোনা আরম্ভ করে ফেলেছিলেন।
যখন আমার প্রথম স্মৃতিবিভ্রাট ঘটে, তখন কিন্তু এগুলো টের পাইনি। সত্যি বলতে কী, ওইসব উদ্ভট ব্যাপারস্যাপার তখন আমাকে পুরোপুরি ঘেঁটে দিয়েছিল। একটা অজানা আদিম অপার্থিব আতঙ্ক আমাকে সবসময় কুরে কুরে খেত। অবস্থা এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে, যাতে নিজের চেহারা দেখতে না হয় তাই আয়না দেখার পাটই দিয়েছিলাম চুকিয়ে। দাড়িও কাটতাম নাপিতের কাছে গিয়ে। আমার চোখ সবরকম রং সহ্য করতে পারত না তাই নীল বা ছাইরঙা পোশাক-পরা কোনও লোককে দেখলে একটা অদ্ভুত স্বস্তি পেতাম। বাদবাকি সময় চাউনি নীচের দিকেই রাখতাম; সরাসরি কোনওদিকে তাকাতাম না। অবশ্য এগুলো আমার ওই উদ্ভট কল্পনার কায়িক আকার নেওয়ার অনেক আগের ঘটনা। ইতিমধ্যে আমি কিন্তু টের পাচ্ছিলাম, কেউ যেন ইচ্ছে করে ওইসব দৃশ্যের ঝলকগুলো আমার সামনে হাজির করছে, যাতে আমি যোগসূত্রগুলো খুঁজে পাই। সত্যি বলতে কী, মানেগুলোও আমি আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিলাম। কালের চক্রের সঙ্গে সঙ্গে ওই অদ্ভুত জ্যামিতিক আকার, পৈশাচিক দৃশ্য– অন্যদিকে আমি আর মাঝখানে সেই যোগসূত্র। এটাও বুঝলাম, কেউ ওগুলোর সঙ্গে আমার মাধ্যমে সংযোগ স্থাপন করতে চাইছে।
এবার আসা যাক আমি যে ঝলকগুলো দেখতাম, সেগুলো প্রসঙ্গে। প্রথমেই বলি, ওগুলো যতটা না ভয়ানক ছিল, তার থেকে অনেক বেশি ছিল উদ্ভট। যেটা আপনা আপনিই একটা আতঙ্কের সৃষ্টি করত। ঘোরের মধ্যে দেখতাম, আমি দাঁড়িয়ে রয়েছি পেল্লায় পেল্লায় পাথুরে খিলানওয়ালা একটা কুঠুরির মধ্যে। অনেকটা রোমান কায়দায় তৈরি ওই খিলানগুলো এমনই সোজা খাড়া উঠে গিয়েছে যে, যতই মাথা উঁচিয়ে দেখি-না কেন ওগুলোর চূড়া দৃষ্টিগোচর হত না! খিলানগুলো আশপাশে কেবল তৈরি করেছে আলো আঁধারি কিছু ছায়া। রোমান কায়দায় তৈরি বিরাট বিরাট গোলাকার জানলা, খিলানওয়ালা দরজা, মাঝে মাঝেই গোলাকার বেদির মতো টেবিল, দেওয়ালে আলো-আঁধারি ঢাকা কাঠের তাক– যেগুলো ঠাসা থাকত আঁকাবাঁকা হায়ারোগ্লিফিকের মতো ভাষা খোদাই করা বইয়ে– এই হল ওই কুঠুরির বর্ণনা। এখন বলার বিষয় হচ্ছে, সব কিছুই ছিল সাধারণ ঘরের থেকে অনেক অনেক বড়। পাথুরে কুঠুরিতে অদ্ভুত সব প্রাগৈতিহাসিক জ্যামিতিক নকশা খোদাই করা থাকত। গোটা কুঠুরিটাই ছিল যেন পেল্লায় আকারের এক গম্বুজ। আর-একটা অদ্ভুত ব্যাপার, ওখানে কোনও চেয়ার ছিল না। কাঠের তাকে হায়ারোগ্লিফিক মার্কা বইয়ের সঙ্গে থাকত কিছু কাগজের তাড়া যেন লেখার কাজে কেউ ওগুলো ব্যবহার করে। আর থাকত চকচকে ধাতুর তৈরি কিছু বয়াম, যার ছুঁচোলো ছিপিগুলোতে মরচে পড়ে গেছে। কুঠুরিতে একটা উঁচু পাদানি ছিল, তাই মাঝে মাঝে আমি ওই পাদানিতে উঠে ওপর থেকে গোটা ঘরটাই দেখতে পেতাম। আলোর কাজ করত ওই কুঠুরিতে রাখা কিছু গোলাকার স্ফটিক। ওই আলোতে বেশ অদ্ভুত ধরনের কিছু যন্ত্রও দেখতে পেতাম। যন্ত্রগুলো অনেকটা আমার সেই অভিশপ্ত দিনে তৈরি করা বিটকেল রড আর নলওয়ালা খুড়োর কলের মতোই দেখতে ছিল। কিছু মোটা গরাদওয়ালা জানলাও ছিল, যদিও আমি কখনওই ওগুলোর ধারেকাছে যাওয়ার সাহস দেখাইনি! এরপর স্বপ্নে আরও কিছু জিনিস যোগ হল। আমি দেখতাম, ওপরে-নীচে দানবীয় নকশাওয়ালা এক পাথুরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে বেড়াচ্ছি। কোনও রাস্তাই তিরিশ ফুটের কম চওড়া ছিল না এবং কোথাও ছিল না কোনও সিঁড়ি। রাক্ষুসে মূর্তিগুলো কম করে হাজার ফুট লম্বা ছিল, কারণ ওগুলো দেখলে মনে হত, ওগুলো যেন আকাশে মিলিয়ে গেছে। এ ছাড়াও ছিল কালোলা রঙের নানা আকারের খিলান আর মুখ আটকে রাখা কিছু দরজা। হয়তো ওগুলোর আড়ালে কোনও ফাঁদ পাতা ছিল, দেখলেই মনে হত, ওগুলো কখনও ভোলা হয়নি। একটা আবছা, ভয়ংকর বিপদের আভাস পেয়ে আমি শিউরে উঠতাম। আমার নিজেকে ওই আতঙ্কপুরীতে এক বন্দি মনে হত। দেওয়ালে আঁকাবাঁকা হায়ারোগ্লিফিক নকশাগুলো যেন আমাকে দেখে ঠাট্টা করে বলত, এ যাত্রায় বেঁচে গেলে হে!
এরপর আমার স্বপ্নে যোগ হল বেশ সুন্দর দেখতে গোল গোল কিছু জানলা আর ওই আতঙ্কপুরীর ছাদ। বিরাট ওই ছাদ থেকে আমি একটা বাগান দেখতে পেতাম। বাগানের বেশির ভাগটাই ছিল পাথুরে আর ঢালু। বাগানের চারদিকে আরও অনেক বিরাট বিরাট বাড়ি দেখতাম। ওই বাড়িগুলোতেও এরকম বাগান ছিল। বাড়িগুলোর সামনে দিয়ে কম করে দু-শো ফুট চওড়া রাস্তা থাকত। বাড়িগুলোর এক-একটার আকার ছিল এক একরকম। কিন্তু কোনওটাই চওড়ায় পাঁচশো ফুট আর লম্বায় হাজার ফুটের কম ছিল বলে মনে হয় না। এক-একটা এতই উঁচু ছিল যে মনে হত, কোনও পাহাড়ি টিলার ওপর রয়েছে। আর মিশে গেছে কোনও ধূসর জগতে, হয়তো যেটাকে আমরা স্বর্গ বলে থাকি। বাড়িগুলো দেখলে মনে হত পাথর আর কংক্রিট দিয়ে তৈরি। এবং ওই বাড়িগুলোর গায়েও আমার আতঙ্কপুরীর মতো হায়ারোগ্লিফিক নকশা আঁকা থাকত। চারদিকে উঁচু পাঁচিল দিয়ে ঘেরা ওই বাড়িগুলোর কোনও কোনওটার সমান ছাদেই বাগান থাকত। আর যে বাড়িগুলো আমার নজরের আওতার বাইরে থাকত, সেগুলোতে কোনও বাগান দেখতে না পেলেও মনে হত, ভেতরে বাগান রয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় নলের মতো দেখতে কিছু উঁচু টাওয়ার দেখতাম। সব কিছু ছাপিয়ে-যাওয়া এই টাওয়ারগুলোর গায়ে খোদাই করা বিটকেল কারিগরিওয়ালা নকশাগুলো দেখে আমি বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যেতাম।