ন্যাথানিয়েল উইনগেট প্রিসলি হিসেবে আমি ফিরে এলাম নিজের মধ্যে। যদিও আমার কাছে দিনটা ছিল সেই অভিশপ্ত বৃহস্পতিবার। ১৪ মে ১৯০৮৷ আমি অর্থনীতির ক্লাস নিচ্ছি।
এই অবধি পড়ার পর কেউ হয়তো ভাবছেন, ১৯১৩ সালে আমার স্মৃতিশক্তি ফিরে আসার পর সব কিছু হয়তো খুব স্বাভাবিক হয়ে যায়। কিন্তু আদপেই তা হয়নি। জীবন থেকে যে পাঁচ-পাঁচটা বছর বেমালুম গায়েব হয়ে গেল, সেই ঘাটতি পোষাতে যে আমাকে কী পরিমাণ নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়েছে তা কেউ ধারণাও করতে পারবেন না। ক্রেন স্ট্রিটের বাড়িতে বসে বসে এই পাঁচ বছর আমার আচরণ (অন্যদের থেকে শোনা) নিয়ে অনেক দার্শনিক ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছি, কিন্তু ধোপে টেকেনি। ভাবতে ভাবতে নিজেই অবাক হয়েছি, আবার বিরক্তও হয়েছি। এই সময় আমার মেজ ছেলে আমাকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাবার সবরকম চেষ্টা চালিয়ে গেছে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ১৯১৪-র ফেব্রুয়ারি নাগাদ ইউনিভার্সিটির চাকরিটায় আবার যোগ দিলাম। আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে লাগলাম, যাতে সব ভন্ডুল না হয়ে যায়। কোনওমতে যাতে চাকরিটা টিকে যায়। এই পাঁচটা বছর যে আমাকে কীভাবে ঘেঁটে দিয়েছে, পদে পদে টের পেতে লাগলাম। আমার আগের মতো মনের জোর আর না থাকলেও নিজের হাবভাব যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চালিয়ে গেলাম। কিন্তু নানারকম অদ্ভুত চিন্তা আর দুঃস্বপ্ন আমাকে নাজেহাল করে রেখেছিল। এদিকে শুরু হল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। আমিও ইতিহাসের বিভিন্ন কালান্তক ঘটনা নিয়ে ভাবতে বসে গেলাম (অবশ্যই একটু অন্যরকমভাবে)। সময় সম্পর্কে আমার ধারণা পুরো পালটে গিয়েছিল। সময়ের বিবর্তন, ধারাবাহিকতা সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল আমার কাছে। সময় নিয়ে নিজেই এক নয়া কাল্পনিক ধারণা বানিয়ে বসলাম। যুগের ঘেরাটোপে আটকে না থেকে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে ছড়িয়ে-থাকা সেই অনন্তব্যাপী জ্ঞানের সমুদ্রে নিজেকে সঁপে দিলাম। এই বিশ্বযুদ্ধের পরিণতি কী হতে চলেছে তা যেন আমার সামনে ছবির মতো ভেসে উঠল ভবিষ্যতের আলোয়। যুদ্ধের সব ভয়াবহ স্মৃতি মগজে জমা রইল, এবং কিছু মানুষের ব্যক্তিগত স্বার্থ কীরকম কৃত্রিমভাবে এই যুদ্ধের মাধ্যমে সারা দুনিয়ার ভোল পালটে দিচ্ছে, সেটাও টের পেলাম। আমি অনেককেই আমার এই ধারণার কথা বলেছিলাম। কেউ কেউ আমার দিকে এমনভাবে তাকিয়ে থাকত যেন আমিই পৃথিবীর সেই অষ্টম আশ্চর্য! গণিত বিভাগের কয়েকজন অবশ্য কিছুটা মন দিয়ে আমার এই ব্যাখ্যা শুনলেন এবং আপেক্ষিকতার ওপর নয়া নয়া আবিষ্কারের ওপর কিছু জ্ঞানও দিলেন আমাকে। ওঁরা যে নিজেদের চেনা গণ্ডির বাইরে বেরোতে চান না, সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম। সময়কালের ওপর আইনস্টাইনের মতবাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও দু-চার কথা শুনতে হল। বিশেষ করে ওই অতিমাত্রিক মতবাদের সমালোচনা।
যা-ই হোক, আবার নিজের কথায় ফিরে আসি। ওইসব দুঃস্বপ্নের ভয়ানক অনুভূতির প্রভাব আমার ওপর এতটাই পড়েছিল যে, ১৯১৫ নাগাদ চাকরিটা ছাড়তে বাধ্য হলাম। যদিও ওই দুঃস্বপ্ন আমার রোজকার রুটিনে ঢুকে গিয়েছিল। কিন্তু যেটা বলার ব্যাপার, সেটা হল, এই সময় ওই দুঃস্বপ্ন একটা নির্দিষ্ট আকার নিতে শুরু করল। টের পেলাম, আমার স্মৃতিবিভ্রাট কোনও সাধারণ ব্যাপার ছিল না। একটা অশুভ ইঙ্গিতের পূর্বাভাস ছিল মাত্র। আমার মনের ঘরে সেই দ্বিতীয় সত্তা অনধিকার প্রবেশ শুরু করে দিল রীতিমতো। উদ্দেশ্য একটাই, আমার প্রাথমিক সত্তাকে হটিয়ে দিয়ে সে-ই থাকবে আমার মগজের নিয়ন্ত্রক হিসেবে। ব্যাপারটা দাঁড়াল এই, একজন চালাতে লাগল আমার শরীর, আর একজন আমার মগজ। এই সময় আমি বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ঘেঁটে আমার এই আচরণ সম্পর্কে খোঁজ লাগালাম এবং আরও ভয় পেয়ে গেলাম। আমার আচরণ হয়তো অন্যদের পিলে চমকে দিয়েছিল, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে যেটা হল, আমার সচেতন আর অবচেতন মনের গণ্ডি গেল ঘুচে। বিভিন্ন অশুভ জ্ঞান আমার মাথায় কিলবিল করে ঘুরত। ওই অভিশপ্ত পাঁচ বছরে বিভিন্ন বইপত্র ঘেঁটে আর নানা জায়গায় ঘুরে আমি যা যা তথ্য পেয়েছিলাম, তার ওপর শুরু করলাম আরও পড়াশোনা আর গবেষণা। যদিও আমার আসন্ন সব বিপদ একই রকম অদ্ভুত ছিল না। এমন কিছু কিছু স্বপ্ন দেখতাম, যেগুলো সেই আসন্ন বিপদ সম্পর্কে ধারণা আরও মজবুত করে তুলত। আমার মেজ ছেলে উইনগেট আর কিছু পরিচিত মনোবিদ ছাড়া কাউকেই কিছু বলিনি। পাশাপাশি স্মৃতিবিভ্রাটের বিভিন্ন কেস নিয়েও ঘাঁটাঘাঁটি শুরু করে দিলাম নিজের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার জন্য। আগেই বলেছি, সেই সময়কার মনোবিজ্ঞানের দুনিয়ায় আমি একজন সেলেব্রিটি হয়ে গিয়েছিলাম, এবং আমার এই দ্বৈত সত্তার কেস নিয়ে যে যে চিকিৎসক, মনোবিজ্ঞানী, পরা-মনোবিজ্ঞানী, এমনকী প্রেততত্ত্ববিদরাও যা যা লিখেছিলেন বা বলেছিলেন, সেগুলো পড়ে ফেললাম। প্রথমে একটু ভয়ের উদ্রেক হলেও, সত্যি বলতে কী, পরের দিকে কিছুটা সান্ত্বনাও পাই। কারণ আমি বুঝেছিলাম যে, আমার ওইসব স্বপ্ন বা আচরণ কোনও সাধারণ স্মৃতিবিভ্রাটের কেস ছিল না। কারণ যে পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমি পাঁচ বছর কাটিয়েছি, তার কাছে এগুলো শিশু। কিছু চিকিৎসা হয়েছিল মান্ধাতার আমলের পদ্ধতিতে, আর কিছুটা ছিল সাংবাদিকদের রং-চড়ানো আষাঢ়ে গল্প। আরও বুঝলাম যে, মানুষের বিবর্তনের বহু যুগ বাদে এই বিরল ঘটনা ঘটেছে, যার শিকার ও সাক্ষী শুধু আমি। হয়তো বিগত কয়েক শতকের ইতিহাস ঘাঁটলে আরও এরকম একটা দুটো কেস পাওয়া যেতে পারে, আবার না-ও পারে। এত ঘাঁটাঘাঁটি করে যেটা সারমর্ম বুঝলাম যে, এই ঘটনার শিকার হয়েছে সবসময় কোনও ভাবুক বা কল্পনাপ্রবণ ব্যক্তি যেমন এক্ষেত্রে আমি। এবং সৃষ্টি হয় এক দ্বিতীয় সত্তার, যা সচেতন ও অবচেতন মনকে শুরু করে দেয় নিয়ন্ত্রণ। এই অপার্থিব সত্তার প্রভাবে কণ্ঠস্বর, আচার-আচরণ সবই যায় পালটে। আগ্রহ জন্মায় ইতিহাস, বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব, পুরাতত্ত্ব ও শিল্পকলা সম্পর্কে। এবং শুধু আগ্রহই জন্মায় না, তার সঙ্গে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চলে জ্ঞান আহরণ। এবং ফলস্বরূপ দেখা দেয় ভয়ংকর সব স্বপ্ন, যার প্রভাবে স্বাভাবিক জীবন হয়ে ওঠে অস্বাভাবিক। এই অবধি জানার পর আমার সেই ভয়ংকর দুঃস্বপ্নগুলোর প্রকৃতি যে ঠিক কীরকম তা বুঝলাম। দু-একটা কেস দেখলাম, যেখানে মহাজাগতিক যোগাযোগের কথাও বলা হয়েছে। বলাই বাহুল্য, সেগুলোর সঙ্গে নিজের ঘটনার মিল পেয়ে আমি আরও আগ্রহী হয়ে উঠলাম। তিনটে কেসে স্পষ্টভাবে কোনও অজানা যন্ত্রের কথা বলা হয়েছে। আমার মনে পড়ে গেল আমার স্মৃতি ফিরে আসার আগের ঘটনা, এইরকম একটা যন্ত্র তো আমিও বানিয়েছিলাম! যে মহাজাগতিক সংযোগের কথা বলা হয়েছে তা অত্যন্ত ভয়ংকর ও অপার্থিব যন্ত্রণার সূত্রপাত ঘটাতে পারে। আরও কয়েকটা জিনিস লক্ষ করলাম। এইসব কেসেই আক্রান্ত ব্যক্তি মাঝারি মানের বুদ্ধিবিশিষ্ট, ওই ধরনের যন্ত্র তৈরির কথা ভাবাও তাদের সাধ্যের বাইরে। দ্বিতীয়ত, এরা প্রত্যেকেই চালিত হয়েছে কোনও অশুভ ভিনগ্রহী শক্তির দ্বারা। তারপরেই সেই স্মৃতিবিভ্রাট ও মগজে থেকে যাওয়া সেই অপার্থিব আতঙ্কের ক্ষীণ স্মৃতি।