১৯০৯ সালে হিমালয়ে প্রায় এক মাস কাটাই। ১৯১১ নাগাদ আবার আরবের এক অচেনা মরুভূমিতে উটের পিঠে চেপে ভবঘুরের মতো ঘুরে বেড়ালাম। অবশ্য ওই অভিযানগুলো একেবারে ব্যর্থ হয়নি। কিছু জিনিস আমি শিখতে পেরেছিলাম। ১৯১২-র গ্রীষ্মে একটা চার্টার্ড জাহাজে করে উত্তর মেরু রওনা হলাম। গন্তব্য স্পিঞ্জ বার্গেনের উত্তরদিক১৮৯। এবারেও হতাশ হলাম। ওই বছরেরই মাঝামাঝি পশ্চিম ভার্জিনিয়ায় একটা পেল্লায় চুনাপাথরের গুহার সন্ধান পেলাম। গুহা তো নয় যেন গোলকধাঁধা! আমার নিজের পায়ের ছাপ খুঁজতেই অসুবিধে হচ্ছিল রীতিমতো। এদিকে আমার নিজের আচরণ দেখে আমি নিজেই ঘাবড়ে যেতাম। ইউনিভার্সিটির লাগোয়া যেখানে থাকতাম, সেখানে সব জায়গায় আমার উন্মাদনার ছাপ ছড়িয়ে ছিল। সব থেকে ঘাবড়ে দেবার মতো ব্যাপার ছিল, সবসময় যেন কোনও দ্বিতীয় সত্তা আমাকে গ্রাস করতে চাইত। যে-কোনও বই আমি একঝলক দেখেই মুখস্থ করে ফেলতাম। যে-কোনও জটিল ধাঁধা যেভাবে মুহূর্তের মধ্যে সমাধান করে ফেলতাম, তা সত্যিই তারিফ করার মতো। এই সময় ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষের কাছে আমার পড়ানো ও অন্যান্য আচরণ নিয়ে বিভিন্ন অভিযোগ আসতে লাগল। যদিও এই চাকরি নিয়ে আমার তেমন কোনও মাথাব্যথা ছিল না। এদিকে আর একটা রিপোর্ট এল, যার বক্তব্য ছিল, আমার সঙ্গে বিভিন্ন গুপ্তবিদ্যার চক্রের নেতাদের যোগাযোগ আছে। ছাত্ররা সন্দেহ করতে লাগল সমান্তরাল জগতের কোনও বাসিন্দাই এই গুপ্তবিদ্যার উপাসক। যদিও এগুলো গুজব হিসেবেই থেকে যায়। কিছুই প্রমাণ হয়নি। আমার ধারণা, আমি লাইব্রেরি থেকে যেসব প্রাচীন আর নিষিদ্ধ বই নিয়ে পড়াশোনা আরম্ভ করেছিলাম, সেগুলোই এই গুজবের উৎস। ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরি বলে কথা! গোপন করা যায়নি। অবশ্য যে বইগুলো থেকে আমি নোটস নিতে শুরু করি, সেগুলো দেখে যে-কোনও কারওই সন্দেহ করার কথা। ডি এরলেটসের কাল্টস ডি গাউলস, লুডউইগ প্রিনের ডি ভারমিন মিস্ট্রিজ, ভন জানৎসের আনঅসপ্ৰেলিচেন কাল্টেন বা সেই উন্মাদ আরব আবদুল আলহাজ্রেডের লেখা কুখ্যাত নেক্রোনমিকন। নিঃসন্দেহে কোনও সক্রিয় অশুভশক্তিই ওই নির্দিষ্ট সময়ের জন্য আমার ভেতর এক অন্য সত্তার সৃষ্টি করেছিল।
১৯১৩-র গ্রীষ্মকালে আমি গতানুগতিক কিছু বিষয়ে আগ্রহ দেখাতে শুরু করলাম। সবাই ভাবল, খুব শিগগির হয়তো আমি স্বাভাবিক হয়ে উঠব। পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ শুরু করলাম। যদিও মনোবিদদের কাছে এগুলো নিছক মেকি বলেই মনে হতে লাগল। হয়তো তারা ভেবেছিল, আমি নিজের পুরোনো লেখালেখি থেকেই এগুলো আয়ত্ত করেছি।
আগস্টের মাঝামাঝি আমি আর্কহ্যাম থেকে ফিরে এসে আস্তানা গাড়লাম বহু দিন ধরে খালি পড়ে-থাকা ক্রেন স্ট্রিটের বাড়িতে। ইউরোপ আর আমেরিকায় নতুন যত কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি পাওয়া যায়, খুব সাবধানে আনাতে লাগলাম। অবশ্যই একেবারে নয়, বারে বারে। কারণ একটাই, যদি কোনও অতিচালাক জিনিসটা বুঝতে পেরে যায় তাহলে মহাসমস্যার সৃষ্টি হবে। যদিও একজন মজুর, কাজের লোক আর হাউসকিপার ছাড়া ব্যাপারটা আর কেউ জানত না। আর তারা এ ব্যাপারে কী-ই বা বুঝত? কাঁড়িখানেক রড, হুইল আর আয়নাসমৃদ্ধ খুড়োর কল। এই খুড়োর কল লম্বায় ছিল দু-ফুট, চওড়ায় এক ফুট আর এর ঘনত্ব ছিল এক ফুট। এর কেন্দ্রের আয়নাটা ছিল উত্তল গোলাকার।
২৬ সেপ্টেম্বর শুক্রবার সন্ধেবেলায় আমি হাউসকিপারকে তার হিসাবপত্র বুঝিয়ে বিদায় করলাম। আর কাজের লোককে বললাম পরের দিন দুপুরের আগে না আসতে। সে দিন অনেক রাত অবধি আমার ক্রেন স্ট্রিটের বাড়িতে আলো জ্বলেছিল। আর কথামতোই এক রোগা, শ্যামলা ভিনদেশি গাড়ি চড়ে এসে হাজির হয়েছিল ক্রেন স্ট্রিটের বাড়ির সামনে। রাত একটা নাগাদ বাড়ির সব আলো জ্বলতে দেখা গিয়েছিল। রাত দুটো পনেরো নাগাদ একজন টহলদারি পুলিশ নাকি দেখেছিল গোটা বাড়িই অন্ধকার, কিন্তু বাড়ির সামনে সেই ভিনদেশির গাড়িটা ঠায় দাঁড়িয়ে। ভোর চারটে নাগাদ হঠাৎ করেই গাড়িটা যেন গায়েব হয়ে যায়। সকাল ছটা নাগাদ খসখসে, ভাঙা গলায় বিদেশি উচ্চারণে কেউ ড. উইলসনকে ফোন করে জানায় আমার অজ্ঞান হয়ে যাবার কথা। পরে ওই ফোন কলের হদিশ পাওয়া যায়। ফোনটা করা হয়েছিল বোস্টনের নর্থ স্টেশনের এক পাবলিক বুথ থেকে। দূরপাল্লার ওই কলের হদিশ পাওয়া গেলেও পাওয়া যায়নি ওই রহস্যময় ভিনদেশির কোনও হদিশ।
ড. উইলসন যখন আমার বাড়ি এলেন, তখন আমি আরামকেদারায় বেহুশ অবস্থায় পড়ে আছি। সামনে একটা টেবিল। ড. উইলসন টেবিলের ওপর অনেক আঁচড়ের দাগ দেখতে পান, যেন কোনও ভারী জিনিস ওপরে আছড়ে পড়েছে। বিদঘুটে সেই খুড়োর কলমার্কা যন্ত্রটাও গায়েব। নিঃসন্দেহে সেই রোগা, শ্যামলা ভিনদেশিই ওটা নিয়ে গিয়েছে। স্মৃতিবিভ্রাটের পর আমি টুকরো কাগজে যা যা লিখেছিলাম, তার সব কিছু পোড়ানো হয়েছে নিপুণভাবে। লাইব্রেরির ঝাঁজরি সেই কাগজ-পোড়া ছাইয়ে ভরতি। ড. উইলসন লক্ষ করেন, আমি খুব অস্বাভাবিকভাবে নিশ্বাস নিচ্ছি। তিনি একটা হাইপোডারমিক ইনজেকশন দেবার পর সেটা স্বাভাবিক হয়।
২৭ সেপ্টেম্বর বেলা এগারোটা পনেরো নাগাদ জোরে ঝটকা মেরে নড়ে উঠি; এবং আমার সেই পাথুরে মুখে স্বাভাবিক অভিব্যক্তি ফিরতে থাকে। ড. উইলসনের মতে, আমার ওই অভিব্যক্তিগুলো কোনও দ্বৈত সত্তার অভিব্যক্তি ছিল না। একেবারেই আমার নিজস্ব ও স্বাভাবিক অভিব্যক্তি। ১১.৩০টা নাগাদ আমি বিড়বিড় করে কিছু বলতে আরম্ভ করি। ড. উইলসনের মতে সেগুলো কোনও পার্থিব ভাষা ছিল না। আমাকে দেখে মনে হচ্ছিল, আমি যেন কোনও কিছুর বিরুদ্ধে আপ্রাণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছি। দুপুরের দিকে বাড়ির কাজের লোক এসে দেখে আমি স্বাভাবিক ভাষায় বিড়বিড় করছি, ওই সময়ের অর্থনীতি ছিল নিতান্তই একমুখী। জেভনস ব্যাখ্যা করেন, ওই সময় অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণকারী যে কোনও বাণিজ্যই বিজ্ঞানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ওঁর মূল প্রচেষ্টা ছিল বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির চক্রের সঙ্গে সৌরকলঙ্কের ক্রমবৃদ্ধির মধ্যে একটা যোগসূত্র স্থাপন…।