মোটামুটি সমতল একটা জায়গায় আসার পর মূল শহর শুরু হল। বাড়িগুলোর ঘনত্ব আর আয়তন দুইই বাড়ল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মনে হচ্ছিল, বাড়িগুলো পরিত্যক্ত। অব্যবহারে আর অযত্নে ধসে গেছে চিমনি, ভেঙে গেছে টালির ছাদ, দেওয়াল বেঁকে বাড়িটাই কোথাও মুখ থুবড়ে পড়েছে সামনে! রাস্তা, ফুটপাথ, সবই নোনা হাওয়ার নিষ্করুণ আদরে ফুটিফাটা হয়ে আছে। আর এইসব ভরে আছে একটা বিশ্রী মেছো গন্ধে।
কয়েকটা মোড় পেরোল আমার বাহন। তারপর যে বাড়িগুলো দেখলাম, সেগুলো নিঃসন্দেহে একদা বড়লোকদের নিবাস ছিল। এই বাড়িগুলোতে আমি মানুষের বসবাসের কিছু চিহ্ন দেখলাম। জানলায় পর্দা, তোবড়ানো গাড়ি, সামনে মোটামুটি চলনসই রাস্তাঘাট –এসবই বুঝিয়ে দিচ্ছিল, এটা ইন্সমাউথের সমৃদ্ধ অংশ (ছিল?)। বাড়িগুলো কম-সে-কম সওয়াশো বছরের পুরোনো। বিশ্রী আঁশটে গন্ধ, আর সর্বাঙ্গে জড়িয়ে-থাকা একটা অস্বস্তিকর ভাব ছাপিয়েও বাড়িগুলোর প্রাচীনত্ব আমাকে আকর্ষণ করছিল। তবে ওই নিয়ে বেশি ভাবার আগেই একটা অন্য জায়গায় এসে পড়লাম।
কোচটা যেখানে দাঁড়ায়, তার আগেই একটা খোলা জায়গা আছে। তার দু-পাশে দুটো গির্জা আছে। সামনে আছে একটা আধমরা ঘাসে ছাওয়া জায়গা। তার আগেই ডান হাতে একটা বড় বড় থামওয়ালা বাড়ি পড়ল। বাড়িটার রং এককালে সাদা ছিল, এখন সব উঠে গেছে বা জ্বলে গেছে। তাতেও বাড়ির নীচের ধাপে কালো আর সোনালি অক্ষরে ডেগন দেবতার দল লেখা ছিল। বুঝলাম, একদা নামকরা একটা প্রতিষ্ঠানের এটিই সাম্প্রতিক চেহারা। দেওয়ালে লেখা অন্য কথাগুলো পাঠোদ্ধার করার চেষ্টা করছিলাম। তখনই বাঁদিক থেকে একটা ঘণ্টার কর্কশ ধ্বনি ভেসে এল।
তাকিয়ে বুঝলাম, আওয়াজটা একটা পাথরের গির্জা থেকে আসছে। বাড়িটা অপেক্ষাকৃত নতুন। জবরজং গড়ন, খুব উঁচু বেসমেন্ট, বন্ধ জানলার সারি– এগুলো একে একে আমার চোখে ধরা পড়ল। বাড়ির মাথায় থাকা ঘড়ির কাঁটাগুলো বোধহয় ভেঙে পড়েছিল। তবু বুঝলাম, এগারোটা বাজছে। ঠিক তখনই আমি এমন একটা কিছু দেখলাম, যেটা এক মুহূর্তের জন্য অন্য সব কিছুকে ভুলিয়ে দিল।
কী দেখলাম আমি?
বেসমেন্টের দরজাটা খোলা ছিল। বাইরের আলো-ঝলমলে দিনের তুলনায় দরজার ওপাশটা ঘন অন্ধকার ঠেকছিল। কিন্তু তার মধ্যে আমি একটা অদ্ভুত চেহারা দেখলাম। বিশ্লেষণ নয়, বরং প্রথম দর্শনেই আমার মনে এমন একটা ভয় দানা বেঁধেছিল যে, আমি দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। তারপর খেয়াল হল ব্যাপারটা কী, আর তখন নিজেকে প্রভূত গালাগাল দিলাম। বুঝলাম, ওই চেহারাটা নিঃসন্দেহে এই গির্জার প্রধান যাজক বা পুরোহিতের। ডাগনের উপাসনার অঙ্গ হিসেবেই নিশ্চয় তাঁর মাথায় কিছু একটা পরানো ছিল… অনেকটা ওই মিউজিয়ামে দেখা টায়রাটার মতো! কিন্তু আমার মাথায় প্রথম দর্শনে সেসব আসেনি। বরং আলোছায়ায় দেখা চেহারাটা তার উচ্চতা, অলংকার এবং আলখাল্লার আড়ালে থাকা চেহারার আভাস নিয়ে আমাকে রীতিমতো আতঙ্কিত করেছিল।
কেমনধারা লোকজন তাদের যাজকের মাথায় ওই বিচিত্ৰদৰ্শন টায়রা বসায়?
ওসব আর ভাবার সময় পেলাম না। আশপাশে দাঁড়িয়ে জটলা-করা গোমড়ামুখো, কুদর্শন কিছু যুবককে দেখলাম। ভাঙাচোরা বাড়িগুলোর চেনা দৃশ্য ছাপিয়ে বেশ কিছুক্ষণ ধরেই একটা জলপ্রপাতের আওয়াজ পাচ্ছিলাম। এবার সেটা খুব জোরালো হয়ে উঠল। দেখলাম, একটা গভীর খাতের সামনে এসে গেছি। তার ওপরের ব্রিজটা পেরোবার সময় দূরে, শহরের প্রান্তে কয়েকটা কারখানা গোছের বাড়ি দেখলাম। দু-পাশ দিয়ে লাফিয়ে পড়া জলপ্রপাতের শব্দে কানে তালা লেগে যাচ্ছিল। সেই জায়গাটা পেরোতেই একটা অর্ধচন্দ্রাকৃতি খোলা জায়গায় এসে থেমে গেল কোচ। তাকিয়ে দেখলাম, ডানদিকে একটা উঁচু, পুরোনো মডেলের, সর্বাঙ্গে কালের কলঙ্ক লেপে-থাকা হলদেটে বাড়ির সামনে এসে গেছি। ভাঙাচোরা কার্নিশের গায়ে লেখা বাড়ির নামটা পড়া যাচ্ছিল।
গিলম্যান হাউস।
ঝটপট বাস থেকে নেমে হোটেলে গেলাম।
.
হোটেলের নোংরা লবিতে একটা বুড়োটে চেহারার লোক আমার নাম-ঠিকানা লিখে ঘরের চাবি দিল। ওর মুখ-চোখ দেখে বুঝতে পারছিলাম, এর মধ্যে সেই ইসমাউথীয় ব্যাপারটা নেই, অর্থাৎ এ স্থানীয় নয়। তা-ও লোকটাকে কিছু জিজ্ঞেস না করে আমি বেরিয়ে পড়লাম স্বচক্ষে শহরটা দেখব বলে। যে জায়গায় বাস আমাকে নামিয়েছিল, সেখানেই গেলাম। তারপর চারদিক যথাসম্ভব খুঁটিয়ে দেখলাম।
পাথর দিয়ে বাঁধানো জায়গাটার উত্তরদিক দিয়ে নদী বয়ে গেছে। অন্যদিকে, মানে দক্ষিণে রয়েছে একশো বছরেরও বেশি পুরোনো একঝাঁক বাড়ি। তাদেরই মধ্য দিয়ে সরু সরু বেশ কয়েকটা রাস্তা বেরিয়ে গেছে দক্ষিণে, দক্ষিণ-পূর্বে, দক্ষিণ-পশ্চিমে। রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টে আলোর সাইজ দেখে বুঝলাম, অন্ধকার নামার আগে এখান থেকে বিদায় নেওয়াই ভালো, সে চাঁদ উঠুক বা না উঠুক।
বাড়িগুলোর চেহারা বাইরে থেকে ঠিকঠাকই লাগল। ডজনখানেক দোকান বা অফিসঘর নজরে পড়ল। একটা বেশ নামকরা সংস্থার দোকান, একটা লজঝড়ে রেস্তরাঁ, ওষুধের দোকান, এক মাছ ব্যবসায়ীর অফিস… আর একেবারে পূর্ব কোণে এই শহরের একমাত্র কারখানা, অর্থাৎ মার্শ রিফাইনিং কোম্পানির অফিস। সব মিলিয়ে গোটা দশেক লোক, আর খান তিনেক গাড়ি আর লরি, ব্যাস! দূরে একদিকে সমুদ্রের নীল আভাস, অন্যদিকে মার্শ রিফাইনারির সাদাটে চিমনি এ দেখে বেশ বুঝতে পারছিলাম, এই জায়গাটাই ইন্সমাউথের বাণিজ্যিক এলাকা বলা চলে।