একটা ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়িটা চলতে শুরু করল। পথেঘাটে থাকা লোকেরা দেখলাম বাসটার দিকে তাকাচ্ছেই না। বুঝলাম, কুসংস্কার হোক বা অন্য কিছু, নিউবারিপোর্টের সাধারণ মানুষের কাছে ইন্সমাউথের মতো এই বাসটাও পরিত্যাজ্য। হাইস স্ট্রিট হয়ে, পুরোনো কলোনিয়াল দালানকোঠা ছাড়িয়ে পার্কার নদী পেরিয়ে আমরা একটা ফাঁকা জায়গায় এসে পড়লাম।
দিনটা রোদ-ঝলমলে ছিল। কিন্তু বালি, আধমরা শুকনো ঘাস আর ক্ষয়টে চেহারার ঝোপ… এসব দেখে আমি ক্রমেই নেতিয়ে পড়ছিলাম। দূরে সমুদ্রের নীল দাগটা দেখতে পাচ্ছিলাম। একটু পরেই রোলি আর ইউইচের বড়রাস্তা ছেড়ে আমাদের কোচ একটা সরু রাস্তায় ঢুকল। রাস্তার হাল দেখে বেশ টের পাচ্ছিলাম, খুব কম গাড়িই এই পথে যাতায়াত করে। কিছু দূর পর পর যে টেলিফোন পোলগুলো কাত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, সেগুলোতেও ছিল মোটে দুটো তার। কিছুক্ষণ পর পরই সরু সরু খাঁড়ি পড়ছিল। কাঠের জীর্ণ ব্রিজের ওপর দিয়ে সেগুলো পার হতে হতে বুঝতে পারছিলাম, ডাঙা আর সমুদ্র দুটোই ইন্সমাউথকে আলাদা করে দিয়েছে আশপাশ থেকে।
মাঝেমধ্যে গাছের কাটা গুঁড়ি আর ভাঙাচোরা দেওয়াল নজরে পড়ছিল। লাইব্রেরিতে পড়েছিলাম, ১৮৪৬-এর মড়কের আগে এই এলাকা রীতিমতো সমৃদ্ধ আর সবুজ ছিল। কিন্তু তারপরেই সব কিছু মরে যায় এখানে। আসলে মড়ক নয়, এদিকের জঙ্গল সাফ করে দিয়েছিল লোকজন। ফলে সমুদ্রের বালি উড়ে এসে মাটি অনুর্বর করে দেয়। তারপরেই এলাকা ফাঁকা হয়ে যায়।
একটা বাঁক নেওয়ার পর প্লাম আইল্যান্ড আমার নজরের আড়ালে চলে গেল। কিন্তু আটলান্টিক তার অনন্ত নীলিমা নিয়ে আমার বাঁদিকে রইল। দেখতে পাচ্ছিলাম, খানাখন্দে ভরা রাস্তাটা একটু একটু করে উঁচু হয়ে যাচ্ছে। মনে হল, যেন অদ্ভুতদর্শন ওই চালকের হাতে গাড়িটা আমাকে রাস্তা ধরে নিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। সেখানে কি মাটির নিরেট ভাবটা আর পাব আমি? নাকি তার বদলে সেখানে থাকবে আকাশের শূন্যতা আর সমুদ্রের অতল রহস্য?
একটু পরেই গাড়িটা ওই উঁচু জায়গাটা পেরিয়ে নীচে নামতে শুরু করল। অনেক দূরে কিংসপোর্টের পাহাড়গুলো দেখা যাচ্ছিল। ওর উত্তরেই ম্যানুক্সেট কেপ অ্যানের দিকে বাঁক। নিয়ে সমুদ্রে মেশে। কিন্তু ওদিকে নয়। আমার নজর আটকে ছিল সামনে ছড়ানো জায়গাটার দিকে।
ইন্সমাউথ!
অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়ানো ছিল শহরটা। বাড়ির সংখ্যা, প্যাঁচালো রাস্তাঘাট… এসব দেখে মনে হয়, শহরটায় অনেকে থাকে, বা থাকত। এখন কিন্তু শহরটা দেখে সবচেয়ে আগে একটাই কথা মনে হয়।
এখানে কি আদৌ কেউ থাকে?
বাড়িগুলোর চিমনি থেকে ধোঁয়া উঠছিল না। সমুদ্রের দিকের দিগন্তে মাথা তোলা তিনটে বিশাল উঁচু শিখরের মধ্যে একটা তো প্রায় পড়ো-পড়ো চেহারায় ছিল। অন্যগুলোতেও জানলা বা ঘড়ি যেখানে থাকার কথা, সেই জায়গাগুলোয় অন্ধকার গর্ত আর জীর্ণ ইট ছাড়া কিছু দেখলাম না। ভাঙাচোরা টালির সমুদ্র, ঝুঁকে-থাকা ছাদ, পচা কাঠের ফ্রেম… সব কিছু একেবারে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিচ্ছিল শহরটার পোকায় কাটা দশাটা।
রাস্তাটা নিচু হচ্ছিল। আমি দেখলাম, এমনকী একদা প্রাসাদোপম বাড়িগুলোতেও ছাদ ধসে পড়েছে। রেললাইনে ঘাস গজিয়েছে। টেলিগ্রাফ পোলে তার নেই। সবচেয়ে ভয়ানক অবস্থা তো সমুদ্রের ধারের বাড়িগুলোয়। তবে সেখানেও ভাঙাচোরা আর প্রায় বালিতে ডুবে-যাওয়া ঘরের মাঝে একটা বেশ উঁচু আর মজবুত বাড়ি দেখলাম। বাড়িটার মাথায় সাদা রঙের একটা ঘণ্টাঘর দেখে সেটাকে কোনও পুরোনো কারখানা বলেই মনে হল।
একটা পুরোনো পাথুরে দেওয়ালের পেছনে থাকা বন্দটার বালিতে প্রায় বুজে গেছে দেখলাম। সেখানে কয়েকজন জেলে বা ওইরকম লোক বসে ছিল বোধহয়। তাদের পাশে ভাঙাচোরা কয়েকটা ঘর, জং-ধরা নোঙর, চিংড়ি ধরার পাত্র– এগুলো দেখে নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলাম, এখানকার লোকজন কি মাছ-টাছ আদৌ ধরে এখন? জায়গাটার শেষ প্রান্তে একটা পরিত্যক্ত বাতিঘরের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পেলাম। ওই কারখানার পাশে যেখানে নদীর একটা শাখা সমুদ্রে এসে পড়েছে, সেই মোহানাতেই কিছুটা গভীর জল আছে বলে মনে হল।
এখানে-সেখানে ভাঙাচোরা জেটি দেখা যাচ্ছিল। সেগুলো ছাড়িয়ে গভীর সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা কালো রেখা দেখতে পেলাম। মনে হল, জলের সামান্য নীচেই যেন একটা লম্বা পাহাড় রয়েছে অনেকটা জায়গা জুড়ে। বুঝলাম, এই হল ডেভিলস রিফ। জায়গাটা আমাকে যুগপৎ বিকর্ষণ আর আকর্ষণ করছিল। কেন… তখন বুঝিনি।
রাস্তায় কাউকে দেখলাম না। বেশ কিছুটা চলার পর কয়েকটা বাড়ি দেখলাম, যেগুলো পোডড়া বাড়ির বিজ্ঞাপন হিসেবে ব্যবহার করা চলে। জরাজীর্ণ দশা, ভাঙা জানলায় কাচের বদলে কাপড় গোঁজা, উঠোনে মরা মাছ ছড়ানো, মৃতপ্রায় গাছ আর আগাছায় ভরা বাগান, পেছনে মেছো গন্ধ আর নোংরায় ভরা সাগরতটে কিছু লোকের নিষ্প্রাণ খোঁড়াখুঁড়ি…! তবে হ্যাঁ, বাড়িগুলোর দশার চেয়েও ভয়ানক ছিল তাদের বাসিন্দারা। নোংরা-মাখা যে বাচ্চাগুলো খেলছিল আশপাশে, তাদের মুখের মধ্যে একটা বাঁদুরে ভাব ছিল। যারা বড়, তাদের চালচলন দেখেও প্রবল অস্বস্তির ভাব জাগছিল। সব মিলিয়ে… আমি ঠিক বোঝাতে পারছি না বোধহয়… এমন একটা ছবি মনে ফুটে উঠছিল, যেটা আমি কোথাও, হয়তো কোনও ভয়ের বইয়ে দেখেছি।