আমার কথাগুলো যত রোমান্টিক শোনাচ্ছে, গয়নাটার খাতায়-কলমে ইতিহাস ততটাই কেঠো শোনাবে। মিস টিলটন বললেন, ইন্সমাউথের এক বাসিন্দা ১৮৭৩ সালে গয়নাটা যাচ্ছেতাইরকম কম দামে বন্ধক রেখেছিল। মাতলামি করার ফলে সে তার একটু পরেই ঝামেলায় পড়ে, শেষে খুনই হয়ে যায়! সোসাইটি জিনিসটা প্রদর্শন করার ব্যবস্থা করে তারপর। কিন্তু ওটার উৎস যে কী হতে পারে, সেই নিয়ে বিশেষজ্ঞরা একমত নন। গয়নাটা ইন্দো-চায়নার হতে পারে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় হতে পারে, এমনকী পূর্ব ভারতের কোনও অজানা জায়গারও হতে পারে! তবে মিস টিলটনের বক্তব্য, নিউ ইংল্যান্ডে এই জিনিস এসে পৌঁছোতে পেরেছে স্রেফ ক্যাপটেন ওবেদ মার্শের জন্য। ওই মানুষটি জলদস্যুদের কোনও একটি লুকোনো ভাণ্ডারের সন্ধান না পেলে এমন বস্তু এখানে আসা অসম্ভব। যুক্তি হিসেবে টিলটন এ-ও বললেন যে, গয়নাটার কথা প্রকাশ পাওয়ার পর থেকে মার্শ পরিবার ওটা কিনে নেওয়ার চেষ্টা করেই যাচ্ছে।
বাড়িটা তালাবন্ধ করে বেরোবার সময় মিস টিলটনের কথা শুনে বুঝলাম, ইন্সমাউথ ওঁর কাছে একটা পিছিয়ে-পড়া, কুসংস্কারাচ্ছন্ন শহর ছাড়া আর কিছু না, যেখানে আমার যাওয়া উচিত হবে না। কারণটা উনি অতি সংক্ষেপে, কাটা-কাটা গলায় বলেই দিলেন।
শ-খানেক বছর আগে ইন্সমাউথে মাছ পাওয়াই যেত না। তারপর ক্যাপটেন মার্শ ফিরে এলেন, আর শহরের ভোলও বদলে গেল! শুধু জলদস্যুদের ভাণ্ডার থেকে পাওয়া সোনাদানাই নয়। মার্শ ইসমাউথে একটা অদ্ভুত ধর্মীয় বিশ্বাস বা প্রথাও তৈরি হতে সাহায্য করেন। যারা ওটা মানে, তারা নিজেদের ডেগন দেবতার দল বলে পরিচয় দেয়। তারাই এখন দলে ভারী। আর পাঁচটা ধর্মীয় বিশ্বাস এখন ওই শহরে কোণঠাসা। এই নিয়ে কিছু বলার নেই, কারণ এখন ওরা সত্যিই মাছ পায়। এত মাছ পায়, যা আশপাশের বন্দরগুলো ভাবতে পারে না! তবে ওইরকম একটা জায়গায় একজন তরতাজা, শিক্ষিত তরুণের গিয়ে লাভ নয়, বরং ক্ষতি হবে বলেই আমার ধারণা।
মিস টিলটন ভালোই চেয়েছিলেন। কিন্তু এই বিচিত্র ইতিহাস, আর তার আড়ালে লুকিয়ে-থাকা অনেক না-বলা কথার আভাস আমাকে চুম্বকের মতো শহরটার দিকে টানছিল।
.
০২.
পরদিন দশটার আগেই আমি পুরোনো বাজারের বাইরে হ্যামন্ডের ওষুধের দোকানের বাইরে দাঁড়িয়ে পড়লাম। সঙ্গে ছিল শুধু নিজের ছোট্ট ব্যাগটা। ইন্সমাউথের জন্য বাসটা আসার সময় যত এগিয়ে এল, ততই দেখলাম, আশপাশটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। বুঝলাম, স্টেশনের ওই এজেন্ট ভদ্রলোক বাড়িয়ে বলেননি। এখানকার লোকজন ইন্সমাউথ তো বটেই, এমনকী বাসটাকেও এড়িয়ে চলতে চায়।
একটু পরেই দেখলাম, একটা লজঝড়ে মোটর-কোচ আসছে। সেটার আসল রং যে কী ছিল, তা এখন ময়লা আর চলটা-পড়া গা থেকে উদ্ধার করা অসম্ভব। নোংরা কাচের ওপর প্রায় অপঠ্য অক্ষরে লেখা ছিল : আর্কহ্যাম-ইন্সমাউথ-নিউবারিপোর্ট। বাহন উপস্থিত হলেও তার চেহারা দেখে মুষড়ে পড়লাম।
বাস থেকে তিনজন লোক নামল। উশকোখুশকো চেহারা, নোংরা পোশাক, বদমেজাজি টাইপের মুখ-চোখ, কম বয়স। তাদের গলায় তফাত যাও! লেখা কোনও সাইনবোর্ড ঝোলানো ছিল না বটে। কিন্তু লোকজন তাদের যেভাবে এড়িয়ে গেল, সেটাই যথেষ্ট শিক্ষাপ্রদ। স্টেট স্ট্রিট ধরে, কেমন একটা চোর-চোর ভাবে, তারা কোথায় যেন চলে গেল। তারপর বাস থেকে নামল ড্রাইভার। সে ওষুধের দোকানে ঢুকল কিছু একটা কিনতে। আমি বুঝলাম, এই নির্ঘাত জো সার্জেন্ট।
লোকটা দোকান থেকে বেরোলে আমি ওকে খুঁটিয়ে দেখলাম। প্রায় ছ-ফুট লম্বা, রোগা, সামনে ঝুঁকে-পড়া লোকটা জীর্ণ, সিভিলিয়ান পোশাকে ছিল। মাথায় একটা গল্ফ ক্যাপ ছাড়া লোকটার পোশাকের আর কিছুই নজর কাড়ে না। তারপর একে একে চোখে ধরা পড়ে লোকটার লম্বা আর চ্যাপটা ঠোঁট, কয়েক গাছি লোম ছাড়া মুখে আর কোনও গোঁফ দাড়ি না-থাকা, প্রায় লেপটে-থাকা কান, গালের জায়গায় জায়গায় অনেকটা চর্মরোগীদের মতো করে ছাল উঠে আসা… তবে এমন সব মনোহর জিনিসের পরেও লোকটার গলার দু-ধার দেখে আমি চমকে উঠলাম। সেখানে এমনভাবে কয়েকটা ভাঁজ পড়েছিল, যা আমরা খুব বেশি বয়স ছাড়া অন্য কারও ক্ষেত্রে ভাবতেই পারি না। অথচ লোকটার বয়স কিছুতেই অত বেশি হতে পারে না! তারপর কিম্ভুত লাগল লোকটার হাতের আঙুলগুলো। কেন যেন মনে হল, ও চাইলে বোধহয় আঙুলগুলো গুটিয়ে মস্ত বড় তালুর মধ্যেই ঢুকে যাবে। হাতের রংও কেমন হলদেটে নীল টাইপের!
লোকটা নিশ্চয় কোনও মাছের বাজারে কাজ করে, কারণ ওর সর্বাঙ্গ থেকে একটা আঁশটে গন্ধ বেরোচ্ছিল। তার চেয়েও বেশি ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, লোকটার এমন চেহারা কী ধরনের বর্ণসংকরায়ণের ফলে হতে পারে, সেটা ভাবতে গিয়েই আমি ঘেঁটে যাচ্ছিলাম। এমন একজনের সঙ্গে একটা লম্বা সফর করতে হবে ভেবেই দমে যাচ্ছিলাম। সেটা আরও বেড়ে গেল, যখন দেখলাম, আমি ছাড়া আর কেউ ওই কোচে চড়বে না। বাধ্য হয়ে আমি লোকটার পিছুপিছু বাসে উঠলাম, আর গন্তব্য হিসেবে ইন্সমাউথ বলে এক ডলারের একটা নোট বাড়িয়ে ধরলাম। জো আমাকে যথেষ্ট কৌতূহলের সঙ্গে শুধু দেখল না, প্রায় মাপল। তারপর চল্লিশ সেন্ট ফেরত দিল, আর কোনও কথা বলল না। আমি ওর দিকেই, কয়েকটা সিট পেছনে বসলাম, যাতে সমুদ্র দেখতে দেখতে যাওয়া যায়।