কিন্তু ক্যাপটেন মার্শ তো মারা গেছেন, তা-ই না?
কমপক্ষে ষাট বছর আগে। কোনও জাহাজও মানুক্সেট মোহানা দিয়ে বেরোয়নি গত ষাট বছরে। কিন্তু… ভদ্রলোক আমার দিকে অদ্ভুতভাবে তাকিয়ে বলেন, ইন্সমাউথের লোকেরা এখনও কাচের পুঁতি, খেলনা– এসব কিনছে। কাদের জন্য?
বুঝলাম। কিছুই না বুঝেও আমি বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়লাম, তাহলে ওখানে যাব না বলছেন?
জায়গাটা সুবিধের নয়। লোকগুলো আরও গোলমেলে। ভদ্রলোক আমাদের দীর্ঘ আলাপচারিতায় ইতি টানতে উদ্যোগী হলেন, আমি সেন্সাস ডিপার্টমেন্ট আর আরও কয়েকটা সরকারি বিভাগের কথা শুনেছি, যাদের কর্মচারী ওখানে গিয়ে আর ফিরে আসেনি। একজন তো বদ্ধ উন্মাদ হয়ে ড্যানভার্স-এ আছে এখন। এই অবস্থায় আপনি ওখানে একদিন একটু ঘুরতে গেলে তা-ও ঠিক আছে। কিন্তু ওখানে থাকা আদৌ বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
এরপর আর কী করার থাকতে পারে? সেই সন্ধেটা আমি নিউবারিপোর্ট পাবলিক লাইব্রেরিতেই কাটালাম। তার আগে স্থানীয় লোকেদের ইন্সমাউথ নিয়ে জিজ্ঞেস করে হতাশ হয়েছিলাম। দোকান, গ্যারেজ, দমকল– এসব জায়গায় কথা বলতে গিয়ে মনে হল, একটা অস্পষ্ট কুসংস্কার গোছের জিনিস রয়েছে জায়গাটা নিয়ে। যেন জায়গাটা নিয়ে বেশি কৌতূহল দেখালে বিপদ হতে পারে। আবার ওয়াইএমসিএ, যেখানে আমি উঠেছিলাম, সেখানে আমাকে স্রেফ বলা হল, অমন একটা রদ্দি, পিছিয়ে-পড়া জায়গায় গিয়ে যেন আমি দিনটা বরবাদ না করি। তাই লাইব্রেরিই ভরসা।
এসেক্স কাউন্টির ইতিহাস নিয়ে লেখা বইগুলো পুরোনো। তবে সেগুলো থেকে আমি কাজের জিনিস খুব একটা পেলাম না। ইন্সমাউথ শহরটা ১৬৪৩ সালে পত্তন করা হয়েছিল। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে ওখানে জাহাজ তৈরি হত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে জায়গাটার দারুণ আর্থিক উন্নতি হয়। কিন্তু ১৮৪৬-এর মড়ক আর দাঙ্গা নিয়ে খুব কম কথা খরচা করেছিল বইগুলো। তারপরেই ইন্সমাউথের আর্থিক বিপর্যয় হয়। গৃহযুদ্ধের পর মার্শ রিফাইনিং কোম্পানির মাধ্যমে সোনা জোগাড় করা, আর বাট তৈরি করে সেগুলো বেচা, এ ছাড়া ইন্সমাউথে আর কোনও শিল্প বা কলকারখানার কথা পাইনি বইগুলোয়। মাছ থেকে রোজগার কম হলেও ইন্সমাউথে মাছের অভাব কখনওই হয়নি, তাই মাছ ধরে এখনও হয়তো বেশ কিছু মানুষের পেট চলে।
শহরটায় বাইরের লোকজন খুব একটা স্বাগত নয়। একেবারে স্পষ্ট করে বলা না হলেও কয়েকটা জিনিস পড়ে মনে হল, পোল্যান্ড আর পোর্তুগাল থেকে আসা কিছু অভিবাসী ওই শহরে বসতি গড়ার চেষ্টা করেছিল। তার পরিণাম ভালো হয়নি।
তবে হ্যাঁ, বইগুলোতে আমি একটা খুব ইন্টারেস্টিং জিনিস বুঝতে পারলাম। ইন্সমাউথের সঙ্গে কিছু বিশেষ ধরনের অলংকারের কথা জড়িয়ে আছে। হয়তো এগুলো থেকেই সোনাটুকু বের করে নেওয়া হত ওই রিফাইনারিতে। কিন্তু তার যে কটা নমুনা জোগাড় করা গিয়েছিল, সেগুলো আর্কহ্যামের মিসকাটোনিক ইউনিভার্সিটি আর নিউবারিপোর্ট হিস্টরিক্যাল সোসাইটির মিউজিয়ামে জায়গা পেয়েছে। ম্যাড়মেড়ে ভাষায় সংক্ষিপ্ত বর্ণনা থেকে গয়নাগুলো নিয়ে কিছু মনে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমার মনে হল, ওগুলোতে কিছু একটা অদ্ভুত ব্যাপার আছে। এই অনুভূতিটা এতই তীব্র ছিল যে, আমি সেই রাতেই অন্তত একটা গয়না দেখতে চাইলাম। বইপত্রে জানলাম, একটা বিচিত্র গড়নের জিনিস, যেটাকে কেউ কেউ টায়রা ভেবেছেন, এই শহরেই আছে। লাইব্রেরিয়ানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করার পুরস্কার পাওয়া গেল। মহিলা স্থানীয় সোসাইটির কিউরেটরের উদ্দেশে একটা নোট লিখে আমার হাতে দিলেন।
কিউরেটর মহিলার নাম মিস অ্যানা টিলটন১৬১। আমার কাতর আবেদন আর ওই নোটের সাঁড়াশি আক্রমণে তিনি সদয় হলেন। সোসাইটি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তবে খুব একটা রাত তখনও হয়নি। তাই তিনি বেশ কয়েকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাকে ওখানে নিয়ে গেলেন। সেই প্রথমবার আমি ইন্সমাউথের কিছু দেখলাম!
প্রথম দৃষ্টিতে জিনিসটাকে এমন কিছু আহামরি মনে হয়নি। কোণের কাবার্ডে রাখা একটা বিটকেল ডিজাইনের জিনিস আলোয় ঝলমল করছে, স্রেফ এটুকুই মনে হয়েছিল। কিন্তু তারপর, একটু একটু করে গয়নাটার সৌন্দর্য আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলল। আমার দুর্বল লেখনী সেই সৌন্দর্যের রহস্য, তার ব্যাখ্যাতীত জটিলতা বোঝাতে পারবে না। শুধু এটুকুই লিখি, এটা যদি টায়রা হয়, তবে যে মাথার জন্য এটা বানানো, তার শরীরের কল্পনাও করা কঠিন।
জিনিসটা কী দিয়ে বানানো ছিল? আমার তো দেখে সোনা বলেই মনে হল। তবে একটা মসৃণ, হালকা স্নিগ্ধতা ছড়িয়ে ছিল পুরো গয়নাটায়, যা থেকে মনে হয় যে, ওই সোনায় অন্য কিছু মেশানো হয়েছিল। কিন্তু উপাদান যা-ই হোক-না কেন, জ্যামিতিক মোটিফের সঙ্গে সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রাণীর চেহারার বৈশিষ্ট্য মিশিয়ে গয়নাটা এমন অসাধারণ কৌশলে আর যত্নে বানানো হয়েছিল যে বলার নয়!
গয়নাটার দিকে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে হচ্ছিল। প্রথমে ভাবলাম, এমন একটা অজানা অচেনা ডিজাইন বলেই হয়তো জিনিসটা এত আকর্ষণীয় ঠেকছে। তারপর বুঝলাম, কারণটা অন্য। গয়নাটার গঠন যে জ্যামিতিক প্যাটার্ন অনুসরণ করেছে, সেটা অঙ্ক বইয়ে পড়ানো জিনিসের থেকে একেবারে আলাদা। গয়নার গায়ে খোদাই-করা বা উঁচু-হয়ে-থাকা মাছ, সরীসৃপ, উভচর এমন নানা প্রাণীর চেহারার সঙ্গে মিশে যাচ্ছিল সেই প্যাটার্নগুলো। ফলে চোখ হয়ে মনে এমন কিছু অনুভূতির জন্ম দিচ্ছিল, যা একই সঙ্গে ভয় আর লালসার জন্ম দেয়।