ওসব নয়। ভদ্রলোক একটু বিরক্ত হন, লোকে বলে, জলের নীচ থেকে উঠে এসে কারা যেন ওখানে প্রায়ই থাকে। বিশ্রাম নেয়। আরও অনেক কিছু করে। আর ক্যাপটেন মার্শের বিরুদ্ধে লোকেদের এত কথার উৎস হল ওই জায়গাটা।
মানে?
ওবেদ মার্শ নাকি রাতবিরেতে ওখানে যেতেন। তাঁকে নামিয়ে দিয়ে নৌকো ফিরে আসত। আবার তাঁকে নিয়ে আসত অনেক পরে। সাধারণ ব্যাখ্যা হল, যে সোনা নিয়ে মার্শের কারবার শুরু, সেগুলো আসলে পুরোনো আমলের জলদস্যুদের লুকিয়ে-রাখা মাল। ওই জায়গার নানা গুহায় ওগুলো হয়তো ছিল। কিন্তু লোকে এই সহজ ব্যাখ্যাটা মানে না। বরং মার্শের সঙ্গে ওখানকার বাসিন্দাদের মেলামেশা নিয়েই তাদের সমস্যা।
তা এই বহিরাগতরা এখন আর ইন্সমাউথে থাকে না? আমি জানতে চাই।
বলা মুশকিল। ভদ্রলোক ঠোঁট বেঁকালেন, ১৮৪৬ সালে ওখানে কিছু একটা মড়ক হয়েছিল। ঠিক কী হয়েছিল বলা মুশকিল। কেউই কিছু বলতে চায় না, হয়তো জানেও না। তবে শহরটা প্রায় সাফ হয়ে যায় ওতেই। এখন ওখানে মেরেকেটে শ-চারেক লোক আছে হয়তো।
কিন্তু এখানকার লোকেরা জায়গাটা এড়িয়ে চলে কেন? আমি ব্যাপারটা বুঝতে পারছিলাম না, ম্মানে এখনও নিশ্চয় সেই মড়কের প্রভাব থাকবে না।
তা হয়তো নেই, তবে অন্য কিছু আছে। এজেন্ট ভদ্রলোক বললেন, হয়তো ক্যাপটেন মার্শের তিনটে জাহাজের সব কটাতেই নাবিকেরা অন্য জায়গায় বিয়েশাদি করেছিল। হয়তো বাইরে থেকে যারা এসেছিল, তারা অন্যরকম ছিল। মোদ্দা কথা হল, ওখানকার বাসিন্দাদের দেখলে কেমন একটা অস্বস্তি হয়। আপনি সার্জেন্টকে দেখবেন বাসে উঠে। ইন্সমাউথের বাসিন্দাদের কারও মাথা সরু, নাক চ্যাপটা, অথচ ফোলা ফোলা বিশাল সাইজের চোখ। ওদের চামড়াও কেমন যেন খসখসে, আঁশ-আঁশ টাইপের। এমনকী গলার পাশের অংশটা রুক্ষ, ভাঁজ-পড়া। ওদের চুলও পড়ে যায় খুব তাড়াতাড়ি। সবচেয়ে বড় কথা হল, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ওদের চেহারা আরও বিকট হয়ে যায়। বাঁচোয়া এই যে, ইন্সমাউথের কোনও বাসিন্দা খুব বেশি বুড়ো হয়েছে, এমন আমি দেখিনি। বেচারিরা বোধহয় বেশি দিন বাঁচেও না!
তাহলে তো… আমার একটু চিন্তা হয় ব্যাপারটা ভেবে, ওই ইনফেকশন বা অসুখটা খুব মারাত্মক ছিল বলতে হবে। নইলে এত দিন ধরে এরকম প্রভাব ফেলা তো চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। তাহলে এই জন্যই এখানকার লোকে ওদের এড়িয়ে চলে।
শুধু লোক নয় মিস্টার। জানোয়াররাও। গম্ভীর গলায় বলেন ভদ্রলোক, ঘোড়া থেকে শুরু করে যাবতীয় জানোয়ার ওদের অপছন্দ করে। এই এলাকায় ওরা আসত-যেত ট্রেনে চেপে, আর তারপর হেঁটে। ব্রাঞ্চ লাইনটা উঠে যাওয়ার পর থেকে ওদের জন্যই ওই বাসটা চলে।
তার মানে ওদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখাটাখাও…? প্রশ্নটা শেষ করি না আমি, তাহলে ওদের চলে কী করে?
মাছ। গম্ভীরভাবে বলেন ভদ্রলোক, যখন সমুদ্রের কোথাও মাছ পাওয়া যায় না, তখনও ইন্সমাউথের জেটিতে নৌকো মাছের ভারে টলমল করে।
মাছেরা ওদের পছন্দ করে বলছেন? আমি হেসে বলি, তা, ওখানে রাত কাটানোর মতো কোনও জায়গা পাওয়া যাবে?
ওখানে গিলম্যান হাউস বলে একটা হোটেল আছে বটে। ব্যাজার মুখে বলেন ভদ্রলোক, তবে ওখানে থাকাটা… তার বদলে আপনি কাল সকাল দশটার বাস ধরে ওখানে যান, আবার ওখান থেকে রাত আটটার বাস ধরে এখানে ফিরে আসুন।
কেন বলুন তো? ভদ্রলোকের মুখ-চোখ দেখে আমার অস্বস্তি হয়, ওখানে কি কোনও গোলমাল আছে? মানে বাইরের লোক গেলে ঝামেলা হতে পারে?
বছর দুয়েক আগের কথা, বুঝলেন। ভদ্রলোক থেমে থেমে বললেন, এক ফ্যাক্টরি ইন্সপেক্টর ওই গোল্ড রিফাইনারি দেখার চক্করে ওখানে গিয়েছিলেন। তারপর গিলম্যান হোটেলেই ছিলেন রাতে। ভদ্রলোক রাতে পাশের ঘরগুলো থেকে কয়েকটা গলা শুনেছিলেন। মানে… গলাগুলো ঠিক… মানুষের গলার মতো নয়। ওঁর মনে হয়েছিল, যেন কোনও জন্তু বা সরীসৃপ টাইপের কিছু কথা বলছে। ভাষাটাও ছিল একেবারে দুর্বোধ্য। তবে সব মিলিয়ে ভদ্রলোক দারুণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। রাতভর চলেছিল ওইসব কথাবার্তা। উনিও না শুয়ে, একেবারে কাঠ হয়ে ছিলেন। ভোর হতেই ভদ্রলোক এলাকা ছাড়েন। ভদ্রলোকের নাম কেসি। আমার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল ওঁর। কেসি ওই রিফাইনারি ইন্সপেক্ট করতে গিয়ে রীতিমতো চমকে গিয়েছিলেন, কারণ ওখানে সোনা কোত্থেকে আসত, আর সেগুলো কোথায় যেত, তার কিছুই বুঝতে পারেননি উনি। এককালে ওটা একটা পুরোনো মিল ছিল। মানুক্সেটের মুখেই বাড়িটা। কেসিও এখানকার লোকেদের মতো ভেবেছিলেন, ক্যাপটেন মার্শ ভিনদেশি বন্দর বা দ্বীপে গিয়ে গয়নাগাটি জোগাড় করতেন। সেগুলোই তারপর জাহাজে করে চালান করা হত অন্য কোথাও, তারপর সেখান থেকে গয়না হয়ে বা টাঁকশালে সেগুলো তলিয়ে যেত।
ভিনদেশি বন্দর? কিন্তু সেখান থেকে ওগুলো জোগাড় করতে গেলেও তো কিছু দিতে হবে বিনিময়ে, তাই না? টাকাপয়সা বা অন্য কিছু।
ঠিক বলেছেন। যেহেতু ক্যাপটেন মার্শ শহরগুলো থেকে প্রচুর পরিমাণে কাচের পুঁতি, দানা, এমনই আরও অনেক সস্তা কিন্তু মনোলোভা জিনিস কিনতেন, লোকে এটাই ভাবত যে, উনি এইসব দিয়ে কোনও দ্বীপের সরল বাসিন্দাদের ঠকাচ্ছেন।
কোন দ্বীপ, সেটা জানা গিয়েছিল?
নাহ্। ভদ্রলোকের হতাশ মাথা নাড়া দেখে বুঝি, এ ব্যথা কী যে ব্যথা! তবে ওই সোনা যাতে থাকত, সেই জিনিসগুলো স্থানীয় নয়, এমনকী চেনাজানা দেশেরও নয়। কিছু নাবিক বা ওই রিফাইনারির লোক চোরাগোপ্তা পথে কয়েকটা জিনিস এদিক-ওদিকে বেচেছিল। সেগুলো দেখে লোকেদের চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল। মানে ওগুলো যদি গলায় পরার হার হয়, তাহলে সেই গলা…।