ঠিক কী হয়েছিল ওখানে, সেটা খুব কম লোকই জানতে পেরেছিল। আশপাশের এলাকায় যারা থাকে, তারা বাইরের লোকের সামনে মুখে তালা দিলেও নিজেদের মধ্যে বিস্তর গজগজ করেছিল। তবে তারা নিজেরাও সত্যিটা পুরোপুরি জানত বলে মনে হয় না। ডাঙার দিকে জলাজমি আর রুক্ষ পাথুরে এলাকা ইঙ্গমাউথকে আশপাশের এলাকা থেকে আলাদা রেখেছিল অনেক দিন। শহরটা, আর সেখানে যারা থাকে, দুটোকেই এড়িয়ে চলার একটা অভ্যাস ম্যাসাচুসেটসের পুরোনো বাসিন্দাদের মধ্যে ছিল।
তবে আমি জানি, কী হয়েছিল ওখানে। যা জানি, সেটা লিখছি। এর চেয়ে বেশি জানতে চাইবেন না, কারণ সেটা আপনাদের পক্ষেও বিপজ্জনক হতে পারে।
১৬ জুলাই ১৯২৭ আমিই ইন্সমাউথ থেকে পালিয়েছিলাম। আমারই কাতর আবেদনে সাড়া দিয়ে প্রথমে কয়েকজন, তারপর একটা সংস্থা, শেষে সেনাবাহিনী ব্যাপারটায় হস্তক্ষেপ করে। এত দিন মুখ বন্ধ করে ছিলাম অনেক কারণে, তবে এখন সেগুলো অর্থহীন।
তাহলে বলি?
পড়াশোনা সেরে বড় হওয়ার পথে অনেকটা এগিয়েছি তখন। ঠিক করলাম, নিউ ইংল্যান্ডের একটু কম-জানা, কম-চেনা জায়গাগুলোয় ঘুরতে যাব। স্রেফ ঝাঁকিদর্শন নয়, বরং স্থানীয় ইতিহাস, সমাজ, আচার-ব্যবহার– এসব দেখা-বোঝাও আমার লক্ষ্য ছিল। সমস্যা হল পয়সাকড়ি নিয়ে। বুঝতেই পারছেন, তখন আমার সংগতি কেমন ছিল। ট্রেন, বাস, ছোটখাটো কোচ– এসবের ভরসাতেই এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাচ্ছিলাম আমি। ঠিক করেছিলাম, ট্রেনে চেপে নিউবারিপোর্ট থেকে আর্কহ্যাম যাব। টিকিটের ভাড়া শুনে চোখ কপালে উঠল। স্টেশন এজেন্ট ভদ্রলোক বোধহয় স্থানীয় নন। আমার অবস্থা দেখে একটু ইতস্তত করে তিনি বললেন, আপনি পুরোনো বাসটা নিতে পারেন।
পুরোনো বাস?
হ্যাঁ। সেইরকম দ্বিধাভরেই ভদ্রলোক বললেন, তবে বাসটা ইন্সমাউথের মধ্য দিয়ে যায়। এখানকার কেউ, এমনকী আর্কহ্যামের কোনও বাসিন্দাও ওটাতে চড়ে না। প্রায় ফাঁকাই দেখেছি ওটাকে। শুধু ইসমাউথে কারও নামার থাকলে সে-ই চড়ে ওতে। বাসটা চালায়ও জো সার্জেন্ট বলে একজন ইন্সমাউথের লোক।
বাসটার ভাড়া কি খুব বেশি? মানে ফাঁকা থাকে বলে জানতে চাইছি।
আরে না না! ভদ্রলোক হেসে বললেন, একেবারে লজঝড়ে জিনিস। ওর টিকিটের দর খুব কম। হ্যামন্ডের দোকানের সামনে থেকে বাসটা দিনে দু-বার ছাড়ে। সন্ধে সাতটায়, আর সকাল দশটায়। ওতেই যান বরং।
আমি সেই প্রথম ইন্সমাউথের নাম শুনলাম। ভাবলাম, আর্কহ্যাম যাওয়ার পথেই যখন পড়ে, তখন ওখানে থেমে জায়গাটা একটু দেখে-শুনে যাব কি না। এজেন্টের কাছেই জায়গাটা নিয়ে জানতে চাইলাম। টিপিক্যাল শহরের লোক যেভাবে গ্রামের বর্ণনা দেয়, সেভাবেই ভদ্রলোক একটা ছোটখাটো বক্তৃতা দিলেন।
ইন্সমাউথ? মানুক্সেট নদীর মোহনায় একটা এঁদো শহর ওটা, বুঝলেন। ১৮১২ সালের যুদ্ধের আগে বেশ বড় বন্দর ছিল বলে শুনেছি, তবে তারপর সব গেছে। রেললাইন ওদিকে যায়নি। এমনকী রোলি থেকে যে ব্রাঞ্চ লাইনটা ছিল, ওটাও তুলে দেওয়া হয় পরে। তাই অন্য কোনও ব্যাবসাবাণিজ্যও গড়ে ওঠেনি। শুধু মাছ আর চিংড়ির কারবার এখনও হয়। আর একটা গোল্ড রিফাইনারি আছে। ওই রিফাইনারিটা কিন্তু সলিড জিনিস। মার্শ, মানে ওটার মালিক, বিশাল ধনী, এমনটাই শুনতে পাই। ভদ্রলোকের কিছু একটা চর্মরোগ হয়েছে বলে উনি লোকচক্ষুর সামনে আসেন না। উনি ক্যাপটেন ওবেদ মার্শের নাতি। ওবেদ মার্শ এই ব্যাবসাটা শুরু করেছিলেন। লোকে বলে, মার্শ নাকি দক্ষিণ সমুদ্রের কোনও এক দ্বীপের একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। এখানকার লোকজনের মন এত ছোট, কী বলব! ভাবুন তো, এক বিদেশিনিকে ঘরে আনার অপরাধে ক্যাপটেন মার্শের পরিবার তো বটেই, গোটা ইন্সমাউথের কোনও পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চায় না এখানকার লোকজন।
শুধু ওই একটা বিয়ের জন্য? আমি জিজ্ঞেস করতে বাধ্য হলাম।
না। তা অবশ্য নয়। মেনে নিলেন ভদ্রলোক, লোকে আরও হাজারটা ভুলভাল কথা বলে ক্যাপটেন মার্শের সম্বন্ধে। আমি স্বকর্ণে শুনেছি, ওরা বলে, ক্যাপটেন মার্শ নাকি শয়তানের সঙ্গে কী সব চুক্তি করেছিলেন। কারা যেন ইন্সমাউথে এসে থাকা শুরু করেছিল। তাদের মাধ্যমে ওখানে শয়তানের উপাসনা, আর আরও সব ভয়ংকর ভয়ংকর প্রথা নাকি শুরু হয়েছিল। ১৮৪৫ সালে নাকি এগুলো সামনেও এসেছিল। জানি না মশাই, আমি নিজে ভারমন্ট থেকে এসেছি অনেক পরে। কিন্তু এইসব হাবিজাবি এরা প্রায় শ খানেক বছর ধরে কানাকানির মতো করে বলে চলেছে।
আচ্ছা, এই যে ইসমাউথে কারা এসে থাকছিল বললেন, আমার মাথায় কৌতূহলের পোকাটা নড়েচড়ে উঠেছিল ততক্ষণে, এরা কোত্থেকে এসেছিল? ওই দক্ষিণের সমুদ্র বা সেখানকার দ্বীপ থেকে?
উঁহু। এই এতক্ষণে ভদ্রলোকের হাবভাবে আমি একটা সিরিয়াস ভাব খুঁজে পাই, আপনি এদিককার ভূগোলটা জানলে একটা বিশেষ জায়গার নাম শুনবেন। একটা প্রবাল প্রাচীর আছে ইন্সমাউথ থেকে কিছুটা দূরে। জায়গাটার নাম ডেভিলস রিফ। বেশির ভাগ সময় ওটা জলের ওপরেই থাকে। বেশ কয়েকটা গুহার মতো গর্ত আছে ওতে। ওর পাশেই একটা বেশ গভীর খাত আছে সমুদ্রের তলায়। ওই জায়গাটাকে নাবিকরা এড়িয়ে চলে।
সে তো যাবেই। ওটুকু আমিও বুঝতে পেরে বলি, ওখানে জাহাজের নীচটা ধাক্কা খেয়ে ফেঁসে গেলে?