এই দৃশ্যায়নের উলটো ক্রমপর্যায় যখন শেষ হল, দেখলাম, অস্ট্রেলিয়ার সেই মরুভূমিতে বালি খামচে পড়ে আছি। আমার চারদিকে এক অদ্ভুত হাওয়া বইছে শনশন করে, এই হাওয়া কোনও পার্থিব হাওয়া নয়। আমার জামাকাপড়ের অবস্থা রীতিমতো শোচনীয়। পুরো ফর্দাফাঁই! দেখলে মনে হবে, কোনও যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরেছি। সারা শরীর কেটে ছড়ে গেছে। সচেতন অবস্থায় আসতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগে গেল। স্বপ্ন, অভিযান– সব কিছুই ক্ষীণ স্মৃতি হিসেবে রয়ে গেল! কোথা থেকে আমার স্বপ্ন শুরু হয়েছিল আর কোথায়ই বা অভিযানের শেষ হয়েছিল, আমার কিছুই মনে নেই। আমার আশপাশে কয়েকটা রাক্ষুসে পাথরের চাঁই যেন দুঃস্বপ্নের অভিযানের সাক্ষী হয়ে ব্যঙ্গের হাসি হাসছে। যা-ই হোক, একটা দুঃস্বপ্নের অভিযান, একটা নারকীয় আতঙ্কের প্রহরের সমাপ্তি ঘটল অবশেষে। এর মধ্যে কতটা সত্যি আর কতটা আমার কল্পনা বা স্বপ্ন, সেটা অজানাই রয়ে গেল। আমার টর্চ, আমার সংগ্রহ-করা বইয়ের বাক্স কিছুই আমার আশপাশে খুঁজে পেলাম না। ওগুলো থাকলে হয়তো সাক্ষী হিসেবে কাজ করত। ওই বইয়ের বাক্সটা দুটো দুনিয়ার মধ্যে মিসিং লিংকের কাজ করতে পারত। কিন্তু সত্যিই কি কোনও পাতালপুরী ছিল? বা ওই বইয়ের বাক্সটা, অথবা সেই প্রাচীনতম সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ? নাকি সবই আমার কল্পনা? কিন্তু আমার এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার জন্য আমার আশপাশে মরুভূমির রুক্ষ বালি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সেই অশুভ হাওয়াটা আর বইছিল না। রাঙাভাঙা চাঁদও পশ্চিমে ঢলে গিয়েছিল। আমিও কোনওরকমে আমার ক্ষতবিক্ষত শরীরটাকে নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম, তারপর রওনা দিলাম ক্যাম্পের দিকে। কিন্তু আমার মনে একটা প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল। যদি আমি জ্ঞান হারিয়ে গোটাটাই স্বপ্ন দেখে থাকি, তাহলে আমি এতক্ষণ বেঁচে রইলাম কী করে? আরও একবার সেই উপকথার গল্পগুলো আমার মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল। যদি ওই পাতালপুরীর অস্তিত্ব সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে ইথরাও সত্যি! আর বিশ্বব্যাপী কালচক্রের সেই চক্রবর্তও একটা হৃদয়বিদারক সত্যি ছাড়া কিছু নয়। সত্যিই হয়তো আমি হারিয়ে গিয়েছিলাম কয়েকশো কোটি বছর আগের প্রাক্-মানবসভ্যতার যুগে আমার সেই অন্ধকারের দিনগুলোয়। হয়তো সত্যিই প্যালিওজিয়ন যুগের কোনও ভিন গ্রহের ভয়ংকরের মনন আমার এই শরীরটাকে ব্যবহার করেছিল সময় অভিযানের বাহন হিসেবে। কিন্তু এর কিছু অংশও যদি সত্যি হয়, তাহলে তো মানবসভ্যতার জন্য অপেক্ষা করছে সেই ভয়াবহ অকাল তমসা! পাশাপাশি এ কথাও ঠিক, এগুলোকে সত্যি হিসেবে প্রমাণ করার জন্য আমার কাছে কোনও প্রমাণ ছিল না। যা-ও-বা ওই বইয়ের বাক্সটা ছিল, সেটাও হারালাম! অবশ্য সত্যি না হলে সেটা গোটা মানবসভ্যতার জন্যই আশীর্বাদ।
যা-ই হোক উইনগেটের জন্য সবই খুঁটিনাটি আমি লিখে রাখলাম। একজন মনস্তাত্ত্বিক আর আমার বিপর্যয়ের সাক্ষী হিসেবে ও-ই না-হয় এগুলোর বিচার করুক। আর শেষ করার আগে একটা কথা বলে রাখা ভালো, ওই পাতালপুরীর নরকে টর্চের আলোয় যখন আমি বাক্স থেকে বইটা বের করে দেখেছিলাম, তখন ঠিক কেন শিউরে উঠেছিলাম। ওই বইয়ের সেলুলোজের পাতায় কোনও প্রাচীন হায়ারোগ্লিফিক বর্ণমালা ছিল না। যা ছিল, সেটা সত্যি হলে সময় আর স্থানের শিশুসুলভ সূত্রের ওপর দাঁড়িয়ে-থাকা মানবসভ্যতা যে কোনও দিন ডুবে যাবে সেই ভয়াবহ অকাল তমসায়। ইথরাও যাদের ভয় পেয়েছিল, তারা শাসন করবে এই গোটা মহাবিশ্ব! হ্যাঁ, ওই বইয়ের সেলুলোজ পাতায় হায়ারোগ্লিফিক বর্ণমালার বদলে আমি দেখেছিলাম নিজের হাতের লেখায় রোজকার খুঁটিনাটি বিবরণ! যে ভাষায় আমি কথা বলতাম মিসকাটনিক ইউনিভার্সিটিতে, সেই চালু ইংরেজিতে!
[প্রথম প্রকাশ: ১৯৩৬ সালে অ্যাস্টাউন্ডিং স্টোরিজ পত্রিকার জুন সংখ্যায় গল্পটি প্রকাশিত হয়। ভাষান্তর: সৌমেন চ্যাটার্জী]
ইন্সমাউথের ইশারা
ইন্সমাউথের ইশারা (THE SHADOW OVER INNSMOUTH)
[ লাভক্র্যাফটের সেরা লেখাগুলির মধ্যে এই গল্পটিতে নিউ ইংল্যান্ডের একটি অখ্যাত গ্রামে অজানা জাতির অমর জীবদের গল্প বলা হয়েছে। লাভক্র্যাফটের নিজের লেখা থেকে পরে জানা যায় গল্পের কথক রবার্ট ওল্মস্টেডের জীবন কীভাবে এক ভয়ংকর অতীতের ছায়ায় অচেনা অন্ধকারে ডুবে যায়। ভিন্ন জাতির মানুষের মধ্যে মিলনে লাভক্র্যাফটের ঘোর আপত্তি থাকলেও গল্পে সেটা ছাপিয়ে মানুষের লোভ ও অমরত্বের লালসাই প্রধান হয়ে উঠেছে।]
০১.
১৯২৭-২৮ সালের শীতটা মনে আছে আপনাদের? ওই বছর ম্যাসাচুসেটসের পুরোনো বন্দর ইঙ্গমাউথে একটা রহস্যময় অপারেশন চালিয়েছিল ফেডারেল এজেন্সিগুলো। ব্যাপারটা সামনে আসে ফেব্রুয়ারি মাসে। ব্যাপক হারে ধরপাকড়, সমুদ্রের লাগোয়া অতগুলো বাড়িকে শুধু জ্বালানো নয়, একেবারে ডিনামাইট দিয়ে ওড়ানো… এগুলো অনেকেরই মনে আছে। লোকে ভেবেছে, এগুলো বেআইনি মদের ভাঁটি ভাঙা বা চোরাচালানের আড্ডা ভেস্তে দেওয়া ছাড়া কিছু না। তবে হ্যাঁ, এত লোক গ্রেফতার হল, অথচ কাউকে জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হল না– এটা ভাববার মতো, তাই না?
ওখানে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছিল, তাদের আর কোনও খবর পাওয়া যায়নি। বোঝেনই তো, সব অপরাধীকে তো আর আইনের সামনে আনা যায় না, কোর্টে দাঁড়িয়ে মিলর্ড বলে চ্যাঁচানোর সুযোগও দেওয়া যায় না। তাদের জন্য আর্মি আর নেভির কিছু ব্যবস্থা থাকেই। ইন্সমাউথের বাসিন্দাদের ডেরা হয়েছিল সেই জায়গাগুলোই। সে জন্যই তো শহরটা এখনও প্রায় ফাঁকা পড়ে আছে। এমনকী প্রেসের লোকেরাও ইসমাউথে ঠিক কী হচ্ছিল, বা কারা সেখানে ছিল– এগুলো জানার পর কেসটা চেপে দেয়। তবে কিছু খবর তো বেরিয়েই যায়। এক সাংবাদিক দাবি করেছিল, নেভির সাবমেরিন থেকে নাকি ডেভিলস রিফের পাশের গভীর খাতটায় টর্পেডো ফায়ার করা হয়েছিল ওই সময়। সেটাকেও তখন নেভির এক্সারসাইজ বলেই চালিয়ে দেওয়া হয়। তারপর একটু একটু করে সব কথা সমুদ্রের নোনা হাওয়া আর বালির তলায় চাপা পড়ে যায়।