এদিকে এই কসরত করতে করতেই ঘটল আসল বিপত্তি! যেই না পরের ধাপে একটা পাথরের ফাঁকে বইয়ের বাক্সটাকে চালান করতে যাব, আমার হাত ফসকে বাক্সটা ঢাল বেয়ে গিয়ে পড়ল ধ্বংসস্তূপের গাদায়। আর শুধু যে পড়ল তা-ই নয়, পড়ে এমন একটা শব্দের সৃষ্টি করল, যে তার প্রতিধ্বনিতে এই পাণ্ডববর্জিত পাতালপুরীর প্রত্যেকটা দেওয়াল যেন কেঁপে উঠল! আর আমার মেরুদণ্ড বেয়ে ভয়ের একটা ঠান্ডা স্রোত বেয়ে গেল। আমি ঠিক যে জিনিসটা মনেপ্রাণে চাইনি, সেটাই হল। আর এই সময়ই বহু দূর থেকে যেন একটা খনখনে, তীব্র শিসের মতো শব্দ ভেসে এল আমার কানে। শব্দটা যে ঠিক কীরকম, ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না। সত্যি কথা বলতে, কোনও পার্থিব শব্দের সঙ্গে এর কোনও মিল নেই, তাই কোনও কিছুর সঙ্গে তুলনা দিয়ে এটা বোঝাতে পারব না। আমি নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন্য বোঝাতে লাগলাম, ওই শব্দ সম্পূর্ণ আমার কল্পনা। কিন্তু আমার সচেতন আর অবচেতন মন এর বিরোধিতা করতে লাগল। যদিও আমার আতঙ্কের শেষ এতেই ঘটেনি, কারণ এরপর যেটা ঘটল, সেটা এতটাই ভয়ানক ছিল যে, ভাবলেও এখন আমি শিউরে উঠছি। আমি বইয়ের বাক্সটাকে হস্তগত করার জন্য দৃঢ়ভাবে টর্চটা ধরে আবার লাফিয়ে লাফিয়ে নেমে এলাম। আমি তো তখন বাইরের দুনিয়ায় চাঁদের আলো আর মরুভূমিতে পৌঁছোবার আনন্দে মশগুল! তাই আমার ধারণা ছিল না, বইটাকে হস্তগত করার পরও এই পৈশাচিক ঘটনাক্রমে কোনও ইতি ঘটবে না। জিনিসটা ঘটল ওই ধ্বংসস্তূপের পাহাড়ের ঢিপির ওপর ওঠার পর। হঠাৎ করেই আমার পা গেল পিছলে, আর আমি শুধু দেখলাম, কিছু গাঁথনি আর পাথরের টুকরোর ধসের সঙ্গে আমিও গড়িয়ে পড়ছি। আর সেই ধসের কী আওয়াজ! মনে হবে, একশোটা কামান যেন একসঙ্গে দাগা হয়েছে। এই বিপর্যয়ের ঠিক পরেই কী ঘটেছিল, আমার মনে ছিল না। যখন আমার হুশ এল, দেখলাম, চাতালের ওপর পড়ে আছি। আমার পাশেই পড়ে রয়েছে আমার টর্চটা আর সেই বইয়ের বাক্সটা। শুধু এইটুকু মনে করতে পারলাম, ওই সশব্দ ধ্বসের সঙ্গে প্রবল গতিতে আমিও নিমজ্জিত হতে চলেছি কোথাও। আর ওই ধসের শব্দে আমার চিৎকারও ঢেকে গিয়েছিল। এদিকে ওই ধসের বিকট শব্দের প্রতিধ্বনি তখনও যেন ফিরে ফিরে আসছে পাতালপুরীর দেওয়াল থেকে। আর ঠিক সময়ই আবার সেই অপার্থিব খনখনে শিসের মতো শব্দটা ভেসে এল খুব স্পষ্টভাবে। নাঃ, এবার আর কোনও ভুল হবার কথা নয়। কারণ এবার শব্দটা আর আমার পিছনদিক থেকে নয়, আসছে সামনের দিক থেকে! সামনের সেই খোলা দরজার ওপারে থাকা সীমাহীন অন্ধকারের মধ্যে থেকে। আর শুধু শব্দই নয়, তার সঙ্গে বইছে এক ভয়ংকর দমকা হাওয়া। আর হাওয়াটা কোনও ঠান্ডা, সোঁদা বা ভ্যাপসা হাওয়া নয়। যেন ওই নরকের অন্ধকারের মধ্যে থেকে কোনও অশুভ উদ্দেশ্য নিয়েই এর আগমন। আর এই হাওয়াটা আমাকে কেন্দ্র করেই যেন কোনও বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বইতে লাগল। আর প্রত্যেক মুহূর্তে এই হাওয়ার দমক বেড়ে চলল। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলল সেই খনখনে শিসের শব্দ। হাওয়ার ধরনটা দেখে মনে হল যেন এটা কোনও ফাঁস বা কাউবয়দের ল্যাসোর মতো আমাকে বেঁধে ফেলতে চাইছে। এবং এই হাওয়ার দমকের সামনে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না। শুধু খেয়াল ছিল, একটা ভয়ানক চক্রবর্তের সঙ্গে আমিও ঘুরছি৷
কতক্ষণ ঘুরেছিলাম খেয়াল নেই, কারণ এরপরেই আমি টর্চ আর বইয়ের বাক্স সহযোগে নিজেকে আবিষ্কার করলাম, কম করে দু-ধাপ নীচের একটা চাতালের ওপর পড়ে আছি, যেখানে ওই গুপ্ত দরজাগুলো হাঁ করে রয়েছে। আমার রীতিমতো কান্না পেল। কিন্তু দেখলাম, কান্নার বদলে আমি বিড়বিড় করছি নিজের মনে হয়তো এটা গোটাটাই একটা স্বপ্ন, হয়তো আমার ঘুম ভাঙবে আর্কহ্যামের পাগলাগারদে কিংবা মরুভূমিতে আমাদের ক্যাম্পে। যদিও আমি জানতাম, ওই ফুট চারেক ফাঁকটা আরেকবার পেরোতে হবে। কিন্তু হয়তো এবার আমার জন্য নতুন কোনও অজানা আতঙ্ক অপেক্ষা করছে। আমি ভেবে দেখলাম, লাফ দিয়ে দিয়ে আমি এগিয়ে যেতে পারব, কিন্তু এক্ষেত্রে আমার সঙ্গী সেই অপার্থিব খনখনে শিসওয়ালা বিভীষিকা। এদিকে আমার টর্চের আলো ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ আমাকে আমার স্মৃতিশক্তির ওপর ভর করেই এগোতে হবে। আর ভেবে দেখলাম, এগিয়ে যেতে গেলে আমাকে এই ভয় কাটাতেই হবে। আর তার জন্য আমাকে এই নারকীয় আতঙ্কের মুখোমুখি হতে হবে। এইসব বাধাবিপত্তির কথা ভাবলে যেটুকু সাহস সঞ্চয় করেছি, সেটুকুও গায়েব হয়ে যাবে। তাই আমি আবার এগোতে লাগলাম। আর ওই ফাটলের কিনারা দেখতে পেলাম। সাহসে ভর করে যেই না এগোতে যাব, ওই ঝোড়ো দমকা হাওয়া, নারকীয় অন্ধকার, অপার্থিব শব্দ– সব কিছুর মিলিত একটা ঘূর্ণি আমাকে গ্রাস করল। শুধু ক্ষীণ স্মৃতি হিসেবে মনে আছে, আমি ওই নারকীয় চক্ৰাবর্তে হারিয়ে যাচ্ছি। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেও ওই চক্ৰাবর্তের মিলিত শব্দের সামনে তা হারিয়ে গেল অচিরেই।
ব্যাস, এই ছিল আমার অভিজ্ঞতা। মানে আমার যতটুকু মনে ছিল, আমি লিপিবদ্ধ করলাম। এর বেশি কিছু বলতে গেলে হয়তো আমাকে আশ্রয় নিতে হবে আমার উন্মাদনা কিংবা অলৌকিক তত্ত্বের। স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, স্মৃতি, পাগলামি– সব কিছুর মিলিত যোগফলে হয়তো জন্ম হয়েছিল কোনও অপার্থিব বিভ্রমের, যার সঙ্গে এই পার্থিব জগতের কোনও কিছুরই মিল নেই। এর বেশি আর কী-ই বা বলতে পারি? যুগ যুগ ধরে এই মহাজাগতিক বিবর্তন, বিভিন্ন গুপ্তবিদ্যা সংক্রান্ত বই নিয়ে পড়াশোনা, রাতের পর রাত দুঃস্বপ্নের মোকাবিলার যোগফলই ঘটেছিল হয়তো-বা। তবে এরপরেও কিন্তু ওই ভয়ানক শহর আমার স্বপ্নে হানা দিয়েছিল। আমিও তখন ইথদের একজন হয়ে গিয়ে শঙ্কু-আকৃতির দেহ নিয়ে চলাফেরা করতাম। শুড়ের সাহায্যে তাক থেকে বই নামিয়ে নিতাম, আবার রেখেও দিতাম। তারপর এই পাতালপুরীর ভয়ানক স্মৃতি (সে সত্যি-মিথ্যে যা-ই হোক না কেন) আর সবশেষে নারকীয় চক্রবর্তে হারিয়ে-যাওয়া সব মিলিয়ে কোনটা কোনটা সত্যিই ঘটেছিল আর কোনটা নিছকই আমার কল্পনা, তা এই মুহূর্তে হয়তো আমার পক্ষে বলা মুশকিল। কারণ এই সব কিছুই ঘটেছিল উলটোক্রমে। নিজেকে ইথরূপে দেখা, চক্ৰাবর্তে হারিয়ে যাওয়া, দমকা হাওয়া আর খনখনে শিসের শব্দ, ধ্বংসস্তূপ বেয়ে ওঠা, বইয়ের বাক্সটা খুঁজে পাওয়া, হায়ারোগ্লিফিক নকশাওয়ালা বইয়ের তাক, আঁকাবাঁকা খিলানওয়ালা পথ, অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে মাথা কুঁড়ে-ওঠা নকশাওয়ালা পাথরের চাঁই, চাঁদনই রাত সব কিছু।