১৫ মে ভোর ৩টে নাগাদ আমি চোখ খুলে কথা বলতে শুরু করি। কিন্তু আমার সেই বিচিত্র ভাষা আর চাউনি দেখে বাড়ির লোকজন আর ডাক্তার রীতিমতো ঘাবড়ে যায়। আমি যে স্মৃতিশক্তি লোপাট হবার ফলে নিজের পরিচিতি পুরোপুরি ভুলে গেছি– এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত হয়। যদিও আমি আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম স্মৃতিবিভ্রাটের ব্যাপারটা গোপন করার। ওই সময় আমি আমার আশপাশের লোকজনদের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকতাম। আমার মুখের পেশির নড়াচড়ার সঙ্গে সেই চাউনির কোনও মিল ছিল না। এমনকী আমার কথাবার্তাও কেমন অদ্ভুত হয়ে গিয়েছিল। গলা দিয়ে যে আওয়াজগুলো বের হত, সেগুলো শুনলে হয়তো কারও মনে হবে, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই ক-টা ইংরেজি শব্দ আমি আয়ত্ত করতে পেরেছি।
প্রায় বছর কুড়ি বাদে ১৯০৮ সালে আর্কহ্যামের সেই বিচিত্র পেশেন্টের রহস্যময় কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে ফলেছিল। প্রথমে ইংল্যান্ড ও পরে আমেরিকায়। আর্কহ্যামের ডাক্তারবাবুরাও নিশ্চয়ই টের পেয়েছিলেন। আমার শারীরিক শক্তি ফিরে এলেও হাত-পা ও অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চালানোর জন্য আমাকে বিশেষভাবে তালিম দেওয়া হত ডাক্তারবাবুদের কড়া তত্ত্বাবধানে। যখন আমি দেখলাম, আমার স্মৃতিবিভ্রাটকে লুকোবার যাবতীয় প্রচেষ্টা মাঠে মারা গেল, তখন বাধ্য হয়ে আমি হাল ছেড়ে দিলাম। ডাক্তারবাবুরা ভাবলেন, ওই স্মৃতিবিভ্রাটকে আমি মেনে নিয়েছি স্বাভাবিক হবার বদলে। ইতিহাস, বিজ্ঞান, ভাষা, শিল্প, উপকথা ইত্যাদি বিষয়ে আমার তুমুল আগ্রহ তাঁদের কাছে দুর্বোধ্য ঠেকল। আবার কিছু আচরণ নেহাতই খোকাগিরি মনে হল তাঁদের। বলাই বাহুল্য, এই পরস্পরবিরোধী ব্যাপারগুলো শুধুই জটিলতা বাড়ায়, আর কিছু নয়। এই সময় আমি লক্ষ করলাম, কোনও অদ্ভুত ভাষায় কে যেন আমার মাথার ভেতর থেকে আমাকে ক্রমাগত নির্দেশ দিয়ে চলেছে। এই ভাষাটাকে পার্থিব কোনও কিছু দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তাই এই ব্যাপারটা লুকিয়ে রাখাই শ্রেয় বলে মনে করি। অতীত বা ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলা আমার কাছে ছেলেখেলার মতো হয়ে যায়। অবশ্য এই ভবিষ্যৎ বলাটা দু-তিনবার মিলে যাওয়ায় রীতিমতো আতঙ্কের সৃষ্টি হয় চারপাশে। একটা জিনিস লক্ষ করেছিলাম, এই ভবিষ্যৎগুলো যখন বলতাম, একটা ভূতুড়ে বিদ্যুতের ঝলক এসেই গায়েব হয়ে যেত। এই ব্যাপারটা আমি ছাড়া আর কেউ লক্ষ করেনি। এদিকে আমি চেষ্টা চালাতে লাগলাম, যত জলদি পারিপার্শ্বিক সব কিছু শিখে নেওয়া যায়। দূর দেশ থেকে কোনও পর্যটক নতুন জায়গায় এলে যেমন করে আর কী। ডাক্তারবাবুদের অনুমতি পাবার পর আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইব্রেরিতে কাটাতে লাগলাম। আমার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে জোগাড় করা, তথ্য আর আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটিতে যেসব গুপ্তবিদ্যা নিয়ে আলোচনা হয়েছে, সেইসব বিষয়ের ওপর লাগাতার গবেষণা চালিয়ে যাওয়া। যেগুলো পরবর্তীকালে রীতিমতো আলোড়ন সৃষ্টি করে।
ইতিমধ্যে সমসাময়িক মনোবিদদের কাছে আমি তখন রীতিমতো এক সেলেব্রিটি। দ্বৈত সত্তার আদর্শ উদাহরণ হিসেবে আমাকে পেশ করে নানা জায়গায় বক্তৃতাও দেওয়া হয়। যদিও বক্তারা আমার আচরণ নিয়ে বক্তৃতায় যা যা বলেছিলেন, সেগুলো আদৌ গুরুত্ব সহকারে বলেছিলেন, নাকি মজা করে তা আমার কাছে আজও রহস্য। এই সময় কারও কাছ থেকেই বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার পাইনি। আমার হাবভাব সবার মনেই ভয়ের সৃষ্টি করেছিল। আমি যেন সুস্থ স্বাভাবিক সব কিছু ছেড়ে ধীরে ধীরে এক আদিম অন্ধকার ও গোপন আতঙ্কের জগতে প্রবেশ করছিলাম। আমার নিজের পরিবারও কোনও ব্যতিক্রমী আচরণ করেনি। আমার স্ত্রী আমাকে দেখে ভয়ে শিউরে উঠত। যেন আমি কোনও ভিন গ্রহের বাসিন্দা। ১৯১০ সালে তার সঙ্গে আমার ডিভোর্স হয়। এমনকী ১৯১৩ সালে আমি স্বাভাবিক হবার পরেও সে আমার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ রাখেনি। এরপর আমার বড় ছেলে আর ছোট মেয়ে কারও সঙ্গেই আমার আর কোনও দিন দেখা হয়নি।
একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল আমার মেজ ছেলে উইনগেট, যার কথা এই লেখার গোড়াতেই আমি বলেছি। আমার আচরণ অচেনা লোকের মতো হলেও উইনগেট সেই ভয়টা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিল। হয়তো ওর কচি মাথা ওকে ভরসা জুগিয়েছিল যে, একদিন ওর বাবা স্বাভাবিক হয়ে উঠবে। পরে যখন আমি আদালতের নির্দেশে রেহাই পেলাম, আমি উইনগেটের কাছেই ছিলাম। উইনগেট আমাকে সমস্তরকম সাহায্য করত। অনেক পড়াশোনা, গবেষণা সে চালায় আমার ওই পরিস্থিতির ওপর। এখন ও মিসকাটনিক ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক, সে কথা তো আগেই বলেছি।
আমি যদিও এগুলো নিয়ে আর ভাবছিলাম না। কারণ সেই অভিশপ্ত বৃহস্পতিবারে আমার যা যা পরিবর্তন হয়েছিল, সেটা আমার এই স্বাভাবিক সত্তার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ১৯০৮ থেকে ১৯১৩- এই পাঁচ বছরে আমার জীবনে ঠিক কী কী ঘটেছিল, হাজার চেষ্টা করলেও আমি আর মনে করতে পারব না। যদি পাঠকরা বিশেষ কৌতূহলী হন তাহলে পুরোনো খবরের কাগজ বা সায়েন্স জার্নালের সাহায্য নিতে পারেন। আমি নিজেও তা-ই নিয়েছি। আমার যা কিছু পুঁজি ছিল, খুব বুঝেসুঝে খরচা করতে হত। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে গবেষণা, পড়াশোনা করতে হত। যদিও আমি একাই যেতাম, কিন্তু জায়গাগুলো এমন পাণ্ডববর্জিত যে, যেতে প্রচুর সময় লাগত, তাই খরচাও যেত বেড়ে।