ওপরে চড়তে চড়তে আমার আঙুলগুলো প্রায় অসাড় হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু যেই না আমি তালাটাকে দেখতে পেলাম, অমনি আমার আঙুলে সাড় ফিরে এল। কিন্তু চমকের তখনও শেষ হয়নি। আমাকে হতভম্ব করে ওই ধাতব দরজা আস্তে আস্তে খুলে গেল!! যেন আমার আসার জন্যই অপেক্ষায় ছিল। এগিয়ে গেলাম ওইদিকে। আমার ডান হাতের কাছেই একটা হায়ারোগ্লিফিক নকশাওয়ালা বইয়ের তাকে একটা বাক্স ছিল। সেটা দেখে আমার ডান হাত এমনভাবে কাঁপতে শুরু করল যে, যন্ত্রণায় প্রায় কুঁকড়ে গেলাম। শুধু মনের জোরে আমি ওই ব্যথাটা ভুলে ছিলাম, নয়তো আর-একটু হলেই হাতটা ফসকে যেত আর কী! বাকি তাকগুলোর থেকে এটা একটু বেশিই বড় ছিল, আর এর বেধ ছিল ইঞ্চি তিনেক। আর এই বাক্সটাতে ছিল অনেকরকম গাণিতিক নকশা। আমি অনেক কসরত করে বাক্সটার নাগাল পেলাম। তারপর কোটের কলারের সঙ্গে আটকে সেটাকে নিয়ে নিলাম পিঠে। আর চিন্তা নেই, এখন আমার হাত খালি। এবার আমি তরতরিয়ে নীচে নামতে লাগলাম। আমার মনে তখন তীব্র কৌতূহল, আমার এত যন্ত্রণা সহ্য করার পর পুরস্কার হিসেবে যে বাক্সটা পেলাম, কী আছে তার ভেতরে? নীচে নেমে ধুলোর ওপরেই হাঁটু গেড়ে বসলাম। তারপর পিঠ থেকে বাক্সটাকে নিয়ে এলাম সামনে। আমার হাত রীতিমতো কাঁপছিল। বাক্সটা খুলে আমি একটা বই বের করলাম। যেন আমার ভেতর থেকে অন্য কারও অদম্য ইচ্ছাশক্তি বইটাকে বের করে আনল। এই বইটার মলাটেও আমার পরিচিত হায়ারোগ্লিফিক নকশা আছে। এবার যেন আমি একটু হলেও আমি বুঝতে পারলাম, ঠিক কী জিনিস খোঁজার জন্য এত দিন আমি অপেক্ষা করেছি আর এত দূর ছুটে এসেছি৷ যদি আমি সত্যিই স্বপ্ন না দেখে থাকি, আর যেটা ভাবছি, সেটা হয়, তাহলে সমগ্র মানবসভ্যতা যে ভয়াবহতার মুখোমুখি হতে চলেছে, তা সহ্য করার ক্ষমতা তাদের নেই। সব থেকে ভয়ানক ব্যাপার হল যে, আমি চেষ্টা করেও এই ঘটনাগুলোকে স্বপ্ন ভেবে উড়িয়ে দিতে পারছিলাম না। এমনকী এটা লিখতে লিখতেই যতবার ঘটনাগুলো মনে পড়ছে, আমার হাত কেঁপে কেঁপে উঠছে।
যা-ই হোক, ঘটনায় ফিরে আসি। বইটার হায়ারোগ্লিফিক নকশাওয়ালা ধাতব মলাটের দিকে তাকিয়ে আমি চুপচাপ বসে রইলাম কিছুক্ষণ। সত্যি বলতে কী, বইটার মলাট উলটে ভেতরে কী আছে, সেটা দেখার জন্য আমার সাহসে কুলোচ্ছিল না। আমার সেই দুঃস্বপ্নে ড্রোনিং মেশিনের সাহায্যে এটার সারমর্মের অনুবাদ করেছিলাম কি না, সেটাও মনে পড়ছিল না। যা হবে, দেখা যাবে ভেবে কপাল ঠুকে আমি মলাট উলটোলাম। ব্যাটারি বাঁচাবার জন্য মুখ থেকে টর্চটা বের করে বন্ধ করলাম। অন্ধকারে বসে বসে খানিকক্ষণ সাহস সঞ্চয় করলাম। তারপর অবশেষে টর্চ জ্বালিয়ে সেই আলোয় তাকালাম খোলা পাতার দিকে।
যা ভেবেছিলাম তা-ই। পাতায় যা লেখা ছিল, সেটা দেখে আমার দাঁতে কাঁপুনি লেগে গেল। হয় আমি স্বপ্ন দেখছি, নয়তো সময় আর স্থান নিয়ে যা যা থিয়োরি আছে, সব ভাঁওতা। আমি ঠিক করলাম, যে করেই হোক, এই বইটা নিয়ে গিয়ে আমার ছেলে উইনগেটকে এটা দেখাতে হবে। যদিও আশপাশের অন্ধকারে আমি অন্য কিছুর অস্তিত্ব টের পাইনি, কিন্তু অতীতের সেই ভয়াবহ স্মৃতির ঝলক আমার চারদিকে ভিড় জমাতে লাগল। আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিল। আমি বইটা বন্ধ করে আবার কোটের কলারের সঙ্গে আটকে পিঠে ঝুলিয়ে নিলাম। সত্যিই যে, এই পাতালপুরীর অস্তিত্ব আছে তা সবার জানা দরকার। অবশ্য বাইরের জগতের এমনকী আমারও আদৌ কোনও অস্তিত্ব আছে কি না, বুঝতে পারছিলাম না। কিন্তু নীচে নামার সময় আমার যে ভয়টা করেনি, সেটা এবার হতে লাগল। মনের জোরে তো এই অবধি আমি নেমে এসেছি। কিন্তু ওই পরিমাণ প্রতিকূলতা কাটিয়ে আবার ফিরে যাবই বা কী করে? আর-একটা ভয় হল, ইথরাও ভয় পেয়েছিল যাদের, তারা হয়তো এখনও এই পাতালপুরীর অন্ধকারে কোথাও ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে। মনের মধ্যে আরও নানারকম ভয় ঘুরতে লাগল। স্থানীয় আদিবাসীদের ঝোড়ো হাওয়ার গল্প, ধ্বংসাবশেষ, শিসের মতো শব্দ, ধুলোর ওপর পায়ার ছাপ, দুঃস্বপ্নে ভেসে আসা জ্যামিতিক আকার– সব মিলেমিশে একেবারে সাড়ে বত্রিশভাজা হয়ে গেল।
ঠিক কী ধরনের অজানা আতঙ্ক আমার জন্য অপেক্ষা করছে, তা যদিও আমার ধারণার বাইরে ছিল। কিন্তু তার কিছু কিছু নমুনা আমি আগে দেখেছিলাম। একটা দেখেছিলাম এখানে ঢোকার আগে একটা খাঁজকাটা দেওয়ালের গায়ে আঁকা একটা চিহ্নে। আর-একটা দেখেছিলাম, প্রথম যে বইটা নামিয়ে নেড়েচেড়ে দেখেছিলাম, তার আগে ধনুকের মতো খিলানওয়ালা আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে গোলাকার গম্বুজওয়ালা হলে। ডানদিকের খিলানটার দিকে তাকালাম। নাঃ, এবার ফিরতে হবে। এটা বেয়ে নেমে এখানে এসে পৌঁছেলেও ফিরতে আমার যে কী অবস্থা হবে, ভেবেই আমার অবস্থা খারাপ হয়ে গেল। পিঠে এই ধাতব মলাটওয়ালা বইয়ের ভার নিয়ে এই ধ্বংসস্তূপ পেরোনো যে খুব সহজ হবে না তা বলাই বাহুল্য! এবং হলও ঠিক তা-ই। এই ধ্বংসস্তূপের এক-একটা টুকরো আমার কাছে হয়ে দাঁড়াল পাহাড়প্রমাণ বাধা। কিন্তু প্রতিকূল অবস্থা অতিক্রম করে করে আমার এমন অবস্থা দাঁড়িয়েছিল, যে নির্দিষ্ট গন্তব্যে না-পৌঁছোনো অবধি আমি হাল ছাড়তাম না। এক্ষেত্রেও তা-ই হল। আমি দেখলাম, অবশেষে আমি এসে পৌঁছেছি সেই পাহাড়ের মতো ধ্বংসস্তূপের ঢিপির সামনে, যেটা পেরিয়ে আমি প্রথম একটু যাওয়ার রাস্তা বানিয়ে নিতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমার মনে একটা ভয় কাজ করছিল। প্রথমবার এখানে ঢোকার সময় কিঞ্চিৎ শব্দের সৃষ্টি হয়েছিল। সেটা যেন আর না হয়। কারণ ধুলোর ওপর ওইসব ছাপ দেখে আর এই পাতালপুরীর ভেতর হাড় হিম করে দেওয়া নানারকম শব্দ শুনে আমার আত্মবিশ্বাস পুরোপুরি আগের মতো ছিল না। আর ওই বাক্সবন্দি বইটা পিঠের ওপর হয়ে দাঁড়িয়েছিল গোদের ওপর বিষফোঁড়া। কিন্তু আমি ওসব তোয়াক্কা না করে এগোতে লাগলাম বেয়ে বেয়ে। টর্চটা কামড়ে ধরলাম মুখে আর বইয়ের বাক্সটাকে ওঠার পথে যা যা ফাঁকফোকর পাচ্ছিলাম, সাময়িক বোঝা লাঘব করার জন্য ঠেলে ঠেলে দিচ্ছিলাম। কিন্তু ওই সাময়িকই! তার পরের মুহূর্তেই পিঠের বোঝার জন্য বেয়ে উঠতে আমার অবস্থা কাহিল হয়ে যাচ্ছিল।