ইতিমধ্যে আমি সব থেকে নীচের ধাপে চলে এসেছিলাম। কিন্তু কথায় বলে না, যেখানে বাঘের ভয়…! ওই অন্ধকারের নাগপাশের জন্যই হয়তো আমার দৌড়ের গতি কিছুটা কমে গিয়েছিল। আর যে জায়গায় এসে গতিটা কমল, আমার বুক ভয়ে কেঁপে উঠল। কারণ আমার পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতা থেকে আমি জানতাম, এই জায়গাটা পার করা
সব থেকে কঠিন। কারণ এখানেই রয়েছে সব থেকে নিরাপত্তাযুক্ত ধাতুর গরাদওয়ালা দরজা। এবং এই দরজা অনধিকার প্রবেশকারীদের জন্য একটা ফাঁদও বটে। এই দরজার পাহারায় থাকত অনেক রক্ষী। যদিও এখন কোনও রক্ষী সেখানে থাকার কথা নয়, কিন্তু তাহলেও ভয়ে আমার হাত-পা কেঁপে উঠল। কারণ কোনওক্রমে এই ব্যাসাল্টের গুহা পার করলেও ঠিক একই রকম আরেকটা দরজার ফাঁদ আমার জন্য অপেক্ষা করছে। হঠাৎ একটা ঠান্ডা কনকনে, ভ্যাপসা হাওয়া আমাকে ওই দরজার দিকে এগিয়ে নিয়ে চলল। আমার ইচ্ছে না থাকলেও ওই হাওয়ার প্রকোপে আমি ওইদিকে যেতে বাধ্য হলাম। যখন ওই হাওয়ার দমক থামল, আমি দেখলাম ওই ধাতুর গরাদগুলো হাঁ করে খোলা! কী করে ওটা খুলে গেল, আমার মাথায় এল না। ওই দমকা হাওয়ার জন্যই হবে হয়তো। যা-ই হোক, আমি আর-একটু এগোলাম। সামনে আবার সেই সারি সারি ধাতুর তাকওয়ালা আলমারি। এবার মেঝের দিকে তাকালাম। এক জায়গায় ধুলোর পাহাড় জমেছে, এবং গোটাকতক আলমারি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ঠিক এই সময়েই এক অজানা আতঙ্কে আমার বুক কেঁপে উঠল। কারণ যে আলমারিগুলো মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, সেগুলো আমার কাছে অপরিচিত ছিল না। সেই বিগ ব্যাং-এর সময় থেকে পৃথিবী সৃষ্টির সমস্ত রহস্য লিপিবদ্ধ হয়ে জায়গা নিয়েছিল ওই তাকে। আর অগুনতি বছর ধরে যখন মাঝে মাঝে কিছু বিরতিতে পৃথিবীর বিবর্তন ঘটেছে, এই আলোহীন গোলকধাঁধাও বিধ্বস্ত হয়েছে। বারেবারে। আর সেই জন্যই এইসব দানবীয় আলমারি যখন নিজেদের জায়গা ছেড়ে হুমড়ি খেয়ে পড়েছে, সেই শব্দের প্রতিধ্বনিতে কেঁপে উঠেছে এই পাতালপুরী।
যখন আর-একটু কাছে এগোলাম, বুঝতে পারলাম, ঠিক কী কারণে আমার বুক কেঁপে উঠেছিল। না, ওই ধুলোর পাহাড় নয়। বরং ওই ধুলোর গাদার মধ্যে বিশেষ কিছু আমাকে ভাবিয়ে তুলেছিল। আমি এবার টর্চের আলোয় ভালোভাবে জায়গাটা দেখলাম। এখানে ঠিক যতটা ধুলো জমে থাকার কথা, ততটা নেই। ঠিক যেন মাসখানেক আগে এখান থেকে কিছু সরানো হয়েছে, কারণ বাকি জায়গার ধুলোর আস্তরণ এর তুলনায় যথেষ্ট পুরু। আরও ভালোভাবে টর্চের আলো ফেলে যা দেখলাম, সেটা আমার কাছে খুব একটা আনন্দদায়ক ছিল না। কারণ ধুলোর ওপর যে তিনটে ছাপ পড়েছিল, সেগুলো ছিল আমার খুব পরিচিত। মিসকাটনিক ইউনিভার্সিটিতে ক্লাস নেওয়ার সময় আমার চোখের সামনে যে বিদঘুটে অপরিচিত জ্যামিতিক আকার ভেসে উঠেছিল, এগুলো ছিল তারই একটা। ঠিক ওই সময়ই আমার ক্লাসরুমের আকারও গিয়েছিল পালটে। ধুলোর ওপর এই ছাপগুলো ছিল কোনও কিছুর বর্গাকার চারটে পায়ার। আর ছাপগুলো ছিল প্রায় গোলাকার আর পাঁচ ইঞ্চি মতো পুরু। চারটে পায়ার একটা বাকি তিনটের তুলনায় দেখলাম একটু বড়। ঠিক যেন এগুলোকে এখান থেকে সরিয়ে নিয়েও কোনও কারণে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু কী কারণ? হয়তো যে কারণে এই দানবীয় ধাতব তাকওয়ালা আলমারি মুখ থুবড়ে পড়েছে বা ঠান্ডা, ভ্যাপসা হাওয়ার প্রকোপে ধাতুর গরাদওয়ালা এই দরজা খুলে গেছে এক নিমেষেই।
হঠাৎ আমার মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত অনুভূতির সৃষ্টি হল, ঠিক কীরকম তা ভাষায় ব্যাখ্যা হয়তো করতে পারব না, কিন্তু এ কথা ঠিক যে, এখন আমার আর আগের মতো ভয় করছিল না। আর ওই পায়ার ছাপগুলো দেখে আমি বুঝতে পারলাম যে, আমার স্বপ্নের কিছু প্রভাব এখনও আমার অবচেতন মনে রয়ে গেছে। এদিকে আমার ডান হাত তখনও সেই বিশেষ কম্বিনেশন তালা খোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আর আমি ওই উলটে পড়া আলমারি আর ধুলোর গাদা পেরিয়ে নিজের অজান্তেই ছুট লাগালাম একটা বিশেষ দিকে, যেন এই রাস্তা আমার কত দিনের পরিচিত! আমার নিজের এই আচরণের কোনও ব্যাখ্যা আমি খুঁজে পেলাম না। শুধু আমার শরীরের কার্যকলাপের সঙ্গে তাল মেলাতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম, কোন প্রাণীর চেতনা এখন আমার শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করছে? কোনও মানুষ কি আদৌ সেই বিশেষ প্রযুক্তির তালার নাগাল পেতে পারে? যে প্রাণীর চিন্তন এখন আমার শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সে কি আদৌ এর কম্বিনেশন জানে? আর জানলেও এত যুগ বাদে সেই তালা কি আদৌ টিকে আছে? মনের মধ্যে প্রশ্নের ঝড় বইতে লাগল। ওই তালাবন্ধ কুঠুরির ওপারে এমন কী রয়েছে, যার মুখোমুখি হবার আগে আমার মন এভাবে ভয়ে কেঁপে উঠছে? আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিল। শুধু এইটুকু মনে ছিল যে, আমার দৌড় সাময়িকভাবে থামিয়ে আমি হাঁ করে তাকিয়েছিলাম একসারি হায়ারোগ্লিফিক লিপি-আঁকা বিরাট দরজাওয়ালা আলমারির দিকে। এগুলোর বৈশিষ্ট্য একটু অন্যরকম ছিল। এগুলো দেখলে মনে হচ্ছিল, এগুলোর কিন্তু যথেষ্ট রক্ষণাবেক্ষণ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে তিনটের দরজা আবার হাট করে খোলা। এগুলো দেখে আমার ঠিক কী মনে হচ্ছিল, ভাষায় বর্ণনা করতে পারব না, শুধু এটুকু বলতে পারি, এগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, এরা বহু যুগ ধরে আমার পরিচিত। আমি তাকগুলোকে একবার মেপে নিলাম। নাঃ, সহজে এগুলোর নাগাল পাওয়া যাবে না। কোনও ফন্দি আঁটতে হবে। খানিকক্ষণ ভেবে একটা উপায় বের করলাম। একটা আলমারির নীচের দিকের খোলা দরজা আর অন্য বন্ধ দরজাগুলোর সাহায্য নিলে হাত পায়ের সাহায্যে বেয়ে বেয়ে ওপরে ওঠা যাবে। সেইভাবেই কোনওরকম শব্দ না করে টর্চটাকে কামড়ে ধরে উঠতে লাগলাম। আমার ডান হাত যেভাবে কাজ করছিল, আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, ওই কম্বিনেশন তালা আমি খুলতে পারব। এখন তালাটা কাজ করলে হয়। এদিকে বন্ধ দরজাগুলোর খাঁজে পা লাগিয়ে আমার উঠতে তেমন কোনও অসুবিধে হচ্ছিল না। হঠাৎ তাক বেয়ে উঠতে উঠতে ডানদিকে চোখ গেল, আর আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত সেই তালাটাকে দেখতে পেলাম।