বারে বারে পিছলে যেতে যেতেও দাঁতে দাঁত চেপে আঁকড়ে ধরেছিলাম পাথরের চাঁইগুলোকে। যুদ্ধশেষে একটা মোটামুটি দাঁড়াবার জায়গা পেয়ে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস নিলাম। এবং অবশেষে টের পেলাম, আমার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যবস্তু সেই লাইব্রেরির খুব কাছাকাছি এসে গেছি। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম, আমি এসে পৌঁছেছি চারদিক বন্ধ খিলানওয়ালা একটা নিচু গোলাকার সমাধিগৃহে। এই সমাধিগৃহের অবস্থা কিন্তু অতটা তথৈবচ নয়। বরং দেখলে মনে হবে, দীর্ঘ দিন ধরে এর রক্ষণাবেক্ষণ হয়েছে। এর দেওয়ালগুলো আমার টর্চের নাগালের মধ্যেই ছিল। তাই টর্চের আলোয় ভালো করে দেখলাম। এবং দেখে চমকে উঠলাম! আরে! এগুলোতে তো হায়ারোগ্লিফিক লেখা ও আঁকিবুকিতে ভরতি! কিছু কিছু আঁকিবুকি তো হুবহু আমার স্বপ্নের মতো। বুঝলাম, আমার নিয়তি আজ আমাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে সেই আলো-আঁধারির দেশে। আমার বাঁদিকের একটা ধনুক আকারের খিলানওয়ালা পথ গেছে দেখলাম, তাই সেদিকেই পা বাড়ালাম। এই পথে এগোতে এগোতে দেখলাম, ওপরে আর নীচে যে অংশগুলো এখনও টিকে আছে, এখান থেকে নাগাল পাওয়া যেতে পারে। একটা জিনিস ভেবে অবাক হয়ে গেলাম সমস্ত পৃথিবী থেকে সুরক্ষিত, সৌরজগতের যুগান্তরের নিখুঁত বর্ণনাসমৃদ্ধ এই তথ্যভাণ্ডার নির্মাণে কী অমানবিক দক্ষতা প্রয়োগ হয়েছে। এই গোটা স্থাপত্যটা নিজেই যেন এক স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম! নিখুঁত গাণিতিক পদ্ধতিতে সিমেন্টের সাহায্যে এই বিরাট পাথরগুলোকে বিস্ময়করভাবে সাজিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই স্থাপত্য। পৃথিবীর কেন্দ্রমণ্ডলের মতোই মজবুত এর ভর। ভাবতে ভাবতে এগিয়ে চললাম। একটা জিনিস খেয়াল করলাম, এই নতুন রাস্তা বানিয়ে নেওয়ার পর তুলনামূলকভাবে হাঁটতে আমার সুবিধে হচ্ছে, বরং একরকম দৌড়েই এগোতে লাগলাম। এই ব্যাপারটা আমাকে একটু হলেও অবাক করল আর ভাবিয়ে তুলল। এযাবৎ ওই দুঃস্বপ্নে আমি যা যা দেখেছিলাম, তার সঙ্গে আমি আমার গতিপথের অস্বাভাবিক মিল দেখে যারপরনাই অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। আমার দু-দিকে হায়ারোগ্লিফিক নকশা-আঁকা ধাতুর দরজা থাকে থাকে তাদের স্বকীয় মহিমায় বিরাজমান। কালচক্রে এই স্থাপত্যের অনেক কিছু ধ্বংসস্তূপে পরিণত হলেও, এগুলোতে তেমনভাবে সময় তার থাবা বসাতে পারেনি। ওই দরজার থাকের সারির মাঝে মাঝে ধুলোর পাহাড় তৈরি হয়েছে। বুঝতে পারলাম, ভূমিকম্পের ফলে এই ফাঁকের সৃষ্টি হয়েছে। মাঝে মাঝে আবার বিভিন্ন লেখাওয়ালা গম্বুজ রয়েছে, যেগুলো দেখে বোঝা যায়, কোন তাকে কী কী খণ্ড রয়েছে, তার বিবরণ রয়েছে ওতে। হঠাৎ দেখি সমাধিঘরের মতো দেখতে একটা ঘরের দরজা খোলা! আমিও থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। দেখি, এখানে কয়েকটা ধাতব তাকওয়ালা আলমারি দিব্যি মাথা উঁচিয়ে রয়েছে, এবং এগুলোতে একটুও ধুলো জমেনি। আমারও এবার গোয়েন্দাগিরির শখ চাগিয়ে উঠল। কসরত করে ওই পেল্লায় আলমারি বেয়ে উঠতে লাগলাম। ওপরের তাকে কয়েকটা রোগাপাতলা নমুনা দেখতে পেলাম। ঠিক করলাম, ওগুলো মাটিতে নামিয়ে একটু পরীক্ষা করে দেখতে হবে, ওগুলোতে ঠিক কী লেখা আছে। যেমন ভাবা, তেমনি কাজ। মাটিতে নামালাম কয়েকটা পাতলা নমুনা।
এবার উলটে-পালটে দেখতে লাগলাম। ধাতব মলাটওয়ালা বইগুলো লম্বায় ছিল কুড়ি ইঞ্চি আর চওড়ায় পনেরো ইঞ্চি। আর বইগুলোর ঘনত্ব ছিল ইঞ্চি দুয়েক। এগুলোর পাতায় পাতায় হায়ারোগ্লিফিক লেখায় ভরতি! এগুলোর কিছু কিছু আমার দুঃস্বপ্নে দেখা হায়ারোগ্লিফিকের মতো। এবার আমি আর-একটু মনোযোগ দিয়ে দেখলাম। এবার আমার মাথায় বিদ্যুতের ঝলকানি দিয়ে উঠল। এগুলোর লেখার পদ্ধতি আমার খুব ভালোভাবে পরিচিত। যখন আমি গবেষণা চালাতাম, এই ধরনের লেখা আমি অনেক দেখেছি। ডি এরলেটসের কাল্টস ডি গাউলস, লুডউইগ প্রিনের ডি ভারমিন মিস্ট্রিজ, ভন জানৎসের আনঅসপ্ৰেলিচেন কাল্টেন, আবদুল আলহাজ্রেডের নেক্রোনমিকন আর সেগুলোর সূত্র ধরে যে যে জিনিস নিয়ে আমি গবেষণা চালিয়েছিলাম, সেটা থেকে এই বইয়ের হায়ারোগ্লিফিক বর্ণমালা যে পদ্ধতি অনুসরণ করেছে, তাতে এর বিষয়বস্তু পুরোপুরি না বুঝলেও এর সম্ভাব্য সারমর্ম কিছুটা হলেও আন্দাজ করলাম। সেলুলোজ দিয়ে তৈরি পাতায় অদ্ভুত রঙিন কালি দিয়ে হায়ারোগ্লিফিকে অনেক কিছু লেখা। কত কালচক্রের ইতিহাস যে লেখা রয়েছে, আন্দাজ করতে পারলাম। এই হায়ারোগ্লিফিক কোনও পরিচিত পার্থিব হায়ারোগ্লিফিক নয়, এ হল সম্পূর্ণ অশুভ অপার্থিব কোনও লিপিমালা। আমার শরীরে আশ্রয় নিয়েছিল যে দূর মেঘলোক থেকে আসা কোনও প্রাণীর চিন্তন, এ হল তার ভাষায় লেখা বিবরণ! কোনও অজানা গ্রহের সৃষ্টির সময়ের বিবরণ হয়তো বন্দি আছে এখানে, তারপর সেটা জায়গা পেয়েছিল ইথদের সংগ্রহশালায়। তবে আমি নিশ্চিত, এ আমাদের পরিচিত সৌরজগতের কোনও গ্রহ২১৬ নয়। এদিকে পাতা ওলটাতে ওলটাতে আমার খেয়াল ছিল না যে, আমার টর্চের ব্যাটারির হাল খারাপ। যখন দেখলাম, ব্যাটারির দৌলতে টর্চ দপদপ করতে শুরু করেছে, চটজলদি ব্যাটারি পালটে নিলাম। আমার সঙ্গে অতিরিক্ত ব্যাটারি সবসময়ই থাকে, তাই কোনও অসুবিধে হল না। আমার দুঃস্বপ্নের জন্য আমি এই গোলকধাঁধা আর অলিগলির অনেকটাই চিনতে পেরেছিলাম, তাই জানতাম বলেই সঙ্গে অতিরিক্ত সরঞ্জাম রেখেছিলাম। এদিকে আমার পায়ের শব্দের প্রতিধ্বনি শুনে নিজেরই কেমন একটা অদ্ভুত লাগছিল। কতকাল এই পাণ্ডববর্জিত ধ্বংসাবশেষে কোনও জীবিত প্রাণীর পায়ের শব্দ শোনা যায়নি, কে জানে? বহু যুগ ধরে জমে-থাকা ধুলোর পরতের ওপর নিজের পায়ের ছাপ দেখে নিজেরই বুকটা কেঁপে উঠল। আমার অবচেতন মন ক্রমাগত জানান দিচ্ছিল, কোনও অশুভশক্তি হয়তো কোথাও ওঁত পেতে রয়েছে। এবার আমি আর-একটু গভীরে যাবার জন্য নীচের দিকে দৌড় লাগালাম। আমার সামনে শুধু টর্চের আলো। দৌড়োনার সময় টর্চের আলোয় অনেক অদ্ভুত জিনিসের নিদর্শন দেখতে পেলেও, একবারের জন্যও থামলাম না। দৌড়ের গতির সঙ্গে কেন জানি না, হয়তো আমার অবচেতন মনের নির্দেশেই বারে বারে ডান হাত ঝাঁকাতে লাগলাম! যেন আমি আধুনিক প্রযুক্তির কোনও বিশেষ কম্বিনেশনের তালা খুলতে চাইছিলাম। স্বপ্নে দেখেছিলাম, নাকি সত্যি জানি না, কিন্তু ওই তালাটার ব্যাপারে যেন আমার অবচেতন মন একশো ভাগ নিশ্চিত ছিল। স্বপ্ন না হলেও হয়তো সেই দুঃস্বপ্ন-ভ্রমণের সময় কোনও প্রাচীন অপার্থিব শক্তি নিখুঁতভাবে আমাকে ওই তালার গঠনপ্রণালী শিখিয়েছিল। এইসব ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে দুঃস্বপ্নের ক্রমাগত মিল খুঁজে পেয়ে আমার মন বারে বারে শিউরে উঠেছিল। এই গোটা ধ্বংসাবশেষ যেন কোনও অলীক অপার্থিব আতঙ্কের ভগ্নাংশমাত্র।