আমার মাথার মধ্যে এবার যেন ঝড় বইতে লাগল। সমস্ত স্মৃতি থমকে থমকে ভিড় জমাল মগজে। আমার ইলেকট্রিক টর্চের কমজোরি আলো দেখে যেন ওই অনন্ত অন্ধকার বিদ্রুপের হাসি হাসতে লাগল। সত্যি বলতে কী, টর্চের ওই আলোয় জায়গাটা আরও ভূতুড়ে লাগছিল। এক জায়গায় দেখলাম, আলশেটা প্রায় পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে, তাই ঠিক করলাম, ওইদিকেই যাওয়া যাক। আলশে থেকে পাথরের চাঁই পড়ে টুকরো টুকরো হয়ে গাদা হয়ে জমে আছে। অনেক কষ্টে সেগুলোর ওপর ওঠা গেল। এই দানবীয় গুহায় আমার আকৃতি ছাড়া সব কিছুই বেশ মিলে যাচ্ছিল আমার দুঃস্বপ্নের সঙ্গে। নিজেকে মনে হচ্ছিল দানবের দেশে গ্যালিভার। যা-ই হোক, টলতে টলতে, লাফ দিয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে আমি কোনওমতে এগিয়ে চললাম আমার কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যের দিকে। একবার তো কোনওমতে টাল সামলালাম, আর-একটু হলে আমার টর্চটাই ভেঙে যাচ্ছিল। তবে আমার এখন আর কোনও কিছু মনে হচ্ছিল না, কারণ এই পাতাল গহ্বরের প্রত্যেকটা ইঞ্চি এখন আমার কাছে পরিচিত মনে হল। মনে হচ্ছিল, এরা যেন আমাকে বলছে, ক্ষণিকের অতিথি হয়ে কেন এলে আমাদের কাছে? আমরা যে যুগ যুগ ধরে তোমার অপেক্ষায় রয়েছি। এসো, আমাদের কাছে এসো।
এখানকার বেশির ভাগ ঘরই হয় ভেঙেচুরে গেছে, নয়তো আবর্জনায় ভরতি। কয়েক জায়গায় দেখলাম, কিছু ধাতব পাত পড়ে আছে। কয়েকটা অক্ষত থাকলেও অধিকাংশই ভেঙেচুরে গেছে। আমি বুঝতে পারলাম, এগুলো হচ্ছে আমার দুঃস্বপ্নে দেখা সেই টেবিলের অংশ, যেগুলোর ওপর রেখে আমি পাতার পর পাতা লিখে চলতাম। এবার একটু নীচের দিকে নামলাম। দেখলাম নীচের দিকটা বেশ ঢালু। এগোতে এগোতে এবার থামলাম। দেখলাম, ফাটলের জন্য সামনে প্রায় ফুট চারেক ফাঁকের সৃষ্টি করেছে। ওই অন্ধকারের জন্য ফাঁকের ভেতরে কী আছে তা আন্দাজ করা ছিল আমার সাধ্যের বাইরে। আমি জানতাম, এই ইমারতের মাটির নীচে আরও দুটো তলা আছে। আর একদম শেষ তলায় আছে ধাতুর তৈরি সেই চিরকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া দরজা। এদিকে এই ফাটল বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে আমার পক্ষে এগোনো রীতিমতো কষ্টকর হয়ে উঠেছিল, কিন্তু কেন জানি না, হয়তো নিজের পাগলামির ভরসাতেই আমি এগোতে থাকলাম বাঁদিকের দেওয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে। এইভাবে পৌঁছোলাম একেবারে শেষের ধাপে। আমার ক্ষীণ স্মৃতি আমাকে বলল, এই পথে গেলেই আমি আমার বহু-আকাঙ্ক্ষিত সেই মেশিন ঘরে পৌঁছোতে পারব। কালের প্রকোপে যেগুলো হয়তো আজ ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে, কিংবা হয়নি! কোথায় কী ছিল, আমার একদম মুখস্থ। তাই বেশ মনের জোর নিয়েই আমি সেই ধ্বংসস্তূপের গাদা পেরিয়ে এগোতে লাগলাম। আমি জানতাম, একসময় এই ত্যারচা বারান্দা পেরিয়েই আমি পৌঁছোতাম সেই দুঃস্বপ্নের লাইব্রেরিতে। তাই আমার আশা ছিল, এবারেও সেখানে পৌঁছে যাব।
যত এগোতে লাগলাম, আমার মনে হল, বহু যুগ ধরে লুকিয়ে রাখা গোপন রহস্য এবার আমার সামনে উন্মোচিত হতে চলেছে। দেওয়াল, বারান্দার ধ্বংসাবশেষ দেখে আমার দুঃস্বপ্নের সঙ্গে কিছু কিছু মিল খুঁজে পেলাম, কিছু আবার নতুন জিনিসও দেখলাম, যেগুলো আগে দেখিনি। আমি জানতাম, মাটির নীচের কোনও রাস্তা এই আতঙ্কপুরীকে মূল রাস্তার সঙ্গে যোগ করেছে। শুধু এই বাড়িই নয়, আশপাশের সেই রাক্ষুসে বাড়িগুলোকেও। তবে এখনও অবধি আমি আমার স্বপ্নের থেকে খুব বেশি কিছু ফারাক খুঁজে পাইনি। খুব আবছাভাবে হলেও, কিছু কিছু রাস্তা আমার এখনও মনে ছিল। তবুও আমি আরও ভাবতে লাগলাম। মাথায় বেশি জোর দেবার ফলে আমার অবস্থা আরও কাহিল হয়ে পড়ল। তবুও আমি মনে করতে পারলাম, মাটির নীচের সেই গোলাকার গম্বুজঅলা ঘর কম করে দু-শো ফুট জুড়ে ছিল। মেঝেটা এতই চকচকে ছিল যে, আমি নিজের ছায়াও দেখতে পেতাম। ইথদের দরকার না-থাকায় এখানে কোনও সিঁড়িও ছিল না। স্বপ্নের সেই দানবীয় মিনারগুলো ইথরা কড়া পাহারায় রক্ষণাবেক্ষণ করত, কিন্তু এখন তো আর সেখানে কোনও পাহারা নেই! ভেবেই আমার মাথা ঘুরতে লাগল।
এবার সেই বারান্দায় এক জায়গায় গিয়ে থামতে বাধ্য হলাম। এখানে পাথরের স্তূপ প্রায় পাহাড়ের মতো উঁচু হয়ে আছে। আর দেখলাম একটা বিশাল বড় গহ্বর, যেটা দেখে বুঝলাম, আমার ইলেকট্রিক টর্চ এখন দেওয়াল বা গহ্বর কোনও কিছু দেখার জন্যই আর কাজে আসবে না। আমার কেন জানি না মনে হল, এটা মাটির নীচের সেই চোরাকুঠুরির কোনও ধাতু দিয়ে তৈরি সীমারেখা। আমি বুঝতে পারলাম, ইথদের সেই তথ্যভাণ্ডারের খুব কাছাকাছি এসে গেছি। কিন্তু তিন নম্বর ধাপে উঠে যা দেখলাম, সেটা সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা ছিল না। মনে হল, এতক্ষণ যা করলাম, সব পণ্ডশ্রম! এত কাঠখড় পুড়িয়ে আবার আমি এসে হাজির হয়েছি নতুন এক প্রকাণ্ড বারান্দায়। এখানে ভাঙাচোরা পাথরের টুকরো প্রায় ছাদ ছুঁয়ে ফেলেছে। এরপর পুরোপুরি হয়তো আমার পাগলামির ওপর ভর করেই হ্যাঁচকা দিয়ে ওই পাথরের স্তূপগুলোকে সরাবার জন্য উদ্যোগী হলাম। স্বপ্ন নাকি সত্যি নাকি দুঃস্বপ্ন জানি না, কিন্তু অনেক কসরত করে একফালি এগোবার রাস্তা বানাতে সক্ষম হলাম। আমার ইলেকট্রিক টর্চ ক্রমাগত জ্বালাতে ও নেবাতে (অবশ্যই ব্যাটারি বাঁচাবার জন্য) লাগলাম পাথর সরাবার কাজে। একবুক তেষ্টা নিয়ে কীভাবে এই অসাধ্য সাধন করলাম, তার বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে গেলে হয়তো আরও একটি অধ্যায় লিখে ফেলতে হবে।