আমি এবার একটু কাছে এগিয়ে ধ্বংসস্তূপের ওপর আমার ইলেকট্রিক টর্চের আলো ফেললাম। প্রায় চল্লিশ ফুট দূরে একটা টিলা দেখতে পেলাম। আমার কেন জানি না মনে হল, এই পাথরের চাঁইগুলো কোনওভাবেই সাধারণ হতে পারে না। এযাবৎ আমরা যে ক টা নমুনা দেখেছি, এগুলো তার থেকে অনেক গভীর অর্থপূর্ণ ছিল। এগুলোর ওপর যে আঁকাবাঁকা রেখাগুলো ছিল, সেগুলো আমি দেখেই চিনতে পারলাম। গবেষণা করে করে এই রেখাগুলো আমার খুবই পরিচিত। অনেক কসরত করে আমি একটু নিচু জায়গা দেখে নামলাম। তারপর এখানে-ওখানে যে বালি লেগেছিল, সেগুলো আঙুল দিয়ে পরিষ্কার করতে লাগলাম। তারপর ক্রমাগত এগুলোর আকার, আকৃতিগত সামঞ্জস্য খুঁজতে লাগলাম। প্রথমে কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলাম না। ঠিক তারপরেই টের পেলাম, এই ধ্বংসস্তূপকে কোথায় দেখেছি! এগুলো হল আমার দুঃস্বপ্নে দেখা সেই রাক্ষুসে তিরিশ ফুট লম্বা ইমারতেরই ভগ্নাংশ! কিন্তু এগুলো ঠিক কত দিন ধরে মাটির নীচে লুকিয়ে ছিল, কোনও কূলকিনারা পেলাম না। আমি এই পেল্লায় ইমারতের লাইব্রেরি, বারান্দা, সেইসব ঘর এবং সর্বোপরি সেই দানবীয় ইথদের অনেক আগেই দেখেছিলাম। আমার মেরুদণ্ড দিয়ে ভয়ের ঠান্ডা স্রোত বইতে লাগল।
হঠাৎ টের পেলাম, সেই পাথরের গাদা থেকে আবার ঠান্ডা, দমকা হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ঠিক যেন গভীর পাতাল থেকে কোনও ঘূর্ণাবর্ত জেগে উঠছে ধীরে ধীরে। বাইরের এই ধ্বংসস্তূপগুলো যার খোলস। আমার প্রথমেই মনে পড়ল স্থানীয় আদিবাসীদের সেইসব উপকথার কথা। কিন্তু তারপরেই আমার মনে পড়ে গেল আমার সেই দুঃস্বপ্নের কথাগুলো। টের পেলাম, আমার বহু আতঙ্কিত রাতের সেইসব দুঃস্বপ্ন এবার সত্যি হতে চলেছে। এই সময় হয়তো আমার পালিয়ে আসাই উচিত ছিল, কিন্তু একটা কৌতূহল আর বৈজ্ঞানিক মানসিকতা যা-ই হোক-না কেন, আমাকে সাহায্য করল সেই ভয়কে জয় করতে। কোনও কিছুর সাহায্য ছাড়াই আমি তরতরিয়ে এগোতে লাগলাম সেই ঠান্ডা ঝোড়ো হাওয়ার উৎসের সন্ধানে। কোনও অলৌকিক বল যেন আমাকে আকর্ষণ করতে লাগল। কী করে জানি না, প্রথমেই আমি এক ঝটকায় একটা পেল্লায় পাথরের চাঁইকে সরিয়ে ফেললাম। আমার শরীরে তখন অমানুষিক শক্তি ভর করেছে। তারপর একের পর এক পাথরকে অনায়াসে সরিয়ে ফেলতে লাগলাম। একটা জিনিস টের পেলাম, এই মরুভূমির দেশে থাকলেও পাথরগুলো কেমন যেন স্যাঁতসেঁতে। তারপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই সেই অলৌকিক বল আমাকে টেনে নিয়ে গেল অতল গহ্বরে। তলিয়ে যাবার সময় আমি আবার সেই বিদ্যুতের ঝলকানি দেখতে পেলাম। যখন হুঁশ ফিরল, দেখি, সেই গহ্বরের মধ্যে আমি পড়ে আছি। আমার আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে সেই ধ্বংসস্তূপের নানা নিদর্শন। পাশেই পড়ে আছে আমার ইলেকট্রিক টর্চ। আমি টর্চটা জ্বালালাম। কিন্তু সেই অন্ধকার ঘোচাবার পক্ষে ওই টর্চ নিছক খেলনা ছাড়া কিছুই নয়। এই মরুভূমির অতলে কত যুগ ধরে এই প্রাচীন সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ রক্ষিত হয়েছে, কে জানে? খুব সম্ভবত পৃথিবীর সৃষ্টির আদিকাল থেকেই। আমি ব্যাটারির আয়ু বাঁচাবার জন্য টর্চটা নেবালাম। আমার আগের অভিজ্ঞতা থেকে স্পষ্ট বুঝলাম, খুব ভয়ানক অশুভ কিছু আমার জন্য অপেক্ষা করছে। যা-ই হোক, আমি হাত ও পা একসঙ্গে কাজে লাগিয়ে এগোতে লাগলাম।
আমার সামনে দুটো রাস্তা খোলা ছিল, সেই দানবীয় আঁকিবুকি-কাটা বিশাল দেওয়াল আর সীমাহীন অন্ধকার। আমি প্রথমটাই বেছে নিলাম। আমি ঠিক কোন পথে নীচে এলাম, সেটা কোনওভাবেই আঁচ করতে পারলাম না। অতঃপর এলোমেলো কিছু স্মৃতির ওপর ভরসা করেই এগোতে লাগলাম। আমার শরীর তখন পুরোপুরি অসাড়। তার ওপর ভয়ও কাজ করছিল। এগোতে এগোতে এতক্ষণে একটা ঘরের মেঝেমতো পেলাম। মেঝের এদিক-ওদিক বিভিন্ন পাথরের টুকরো পড়ে আছে। সঙ্গে ধুলো ও জঞ্জাল। ঘরের অন্যদিকে প্রায় তিরিশ ফুট উঁচু একটা দেওয়াল উঁচু হয়ে কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে। ওই দেওয়ালেও আঁকিবুকি থাকলেও সেগুলো ঠিক কীরকম এত দূর থেকে আমি ঠাহর করতে পারলাম না। কিন্তু যে জিনিসটা দেখে আমি সব থেকে ঘাবড়ে গেলাম, সেটা হল এই ঘরের ধনুকের মতো বাঁকানো ছাদ। যদিও টর্চের আলোয় সবটা বোঝা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, কিন্তু ওই ছাদের নীচের অংশটা দেখেই আমি বুঝতে পারলাম এগুলো আমার সেই দুঃস্বপ্নের পাতালপুরীর মতোই! এই অতল গহ্বর থেকে আমি কী করে ফিরব, কোনওভাবেই বুঝে উঠতে পারলাম না। আমি এবার আমার বাঁদিকের দেওয়ালের দিকে এগিয়ে গেলাম। এই দেওয়ালটা অন্যগুলোর থেকে কিছুটা কম এবড়োখেবড়ো ছিল। অনেক কষ্টে আমি এগোতে লাগলাম। এগোনোর সময় আমি কয়েকটা পাথরের টুকরোকে জঞ্জালের গাদায় ঠেলে দিতেই টের পেলাম এই ঘরের শান-বাঁধানো মেঝেও হুবহু আমার আতঙ্কপুরীর মতোই।
এবার আমি টর্চটা আবার জ্বেলে ভালোভাবে দেখলাম। বেলেপাথরের ওপর কোনও জলপ্রবাহের ক্রিয়ায় কিছু কিছু জায়গা আলগা আর নরম হয়ে ভেঙেচুরে গেছে। কিন্তু যেটা দেখে আমি সব থেকে বেশি অবাক হলাম, সেটা হচ্ছে পাথরের ওপর আঁকিবুকি নকশাগুলো দেখে। এগুলো হচ্ছে সেই নকশা, যা বহু যুগের আতঙ্ককে একসঙ্গে আমার অবচেতন মন দেখতে পেয়েছিল। রাতের পর রাত আমি দেখেছিলাম দুঃস্বপ্ন। যে দুঃস্বপ্ন আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে এসেছে এত দূর। এই ধ্বংসস্তূপের প্রত্যেক টুকরোর সঙ্গে আমি পরিচিত, ঠিক আর্কহ্যামে আমার ক্রেন স্ট্রিটের বাড়ির মতোই। কিন্তু স্বপ্নে আমি যা দেখেছি, তার থেকে অনেক অনেক বেশি ভয়াবহ বাস্তবে এই দুঃস্বপ্নের নগরীতে হাজির হওয়া। এই আতঙ্ককে হুবহু ভাষায় বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার দুঃস্বপ্নে আমি যেসব জলজ্যান্ত বিভীষিকাকে দেখেছিলাম, যদি তাদের মুখোমুখি হই, তাহলে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করব এবং আদৌ পারব কি না, সেটা ভেবেই আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেল। হঠাৎ করেই আমি যেন আমার চারপাশে সেইসব বিভীষিকার অস্তিত্ব টের পেতে লাগলাম। অন্ধকারের কোথাও যেন তারা ঘাপটি মেরে আমাকে লক্ষ করছে। দুঃস্বপ্নের সেইসব দৃশ্য আমার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল। এখনও কি সেই লাইব্রেরিতে ইথরা ঘুরে বেড়ায়? এখনও কি সেই আতঙ্কপুরীর বারান্দা আর বন্ধ কুঠুরিগুলোর অস্তিত্ব আছে? যদিও আমার স্বপ্নে দেখা আর ওইসব কিংবদন্তির অনেক কিছুই ভবিষ্যতের ইতিহাসের খোলনলচে পালটে দিয়েছিল। অবশ্যই এক ভয়ানক উন্মাদনা আমাকে গ্রাস করেছিল, কিন্তু যে ভয়াবহতার সামনে এখন আমি দাঁড়িয়ে তার কাছে সেগুলো কিছুই নয়। এই সময় আমার হঠাৎ করেই মনে পড়ল ইথদের সেই লাইব্রেরির কথা, যেখানে আমিও তাদের মতো একজন হয়ে গিয়ে ঝড়ের গতিতে লিখে চলতাম পাতার পর পাতা। যদি সত্যিই ওরকম কিছুর অস্তিত্ব থেকে থাকে, তাহলে আমি নিমেষেই সেখানে পৌঁছোতে পারব।