এইবার আমি আমার এই লেখার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ সম্পর্কে বলতে চলেছি। কারণ একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত ছিলাম যে, এগুলো কখনওই আমার কল্পনা বা স্বপ্ন নয়, ভয়ংকর রকমের সত্যি। কারণ আমার মেজ ছেলের মনোবিজ্ঞানের যথেষ্ট জ্ঞান ছিল, আর ও কখনওই এই বিষয়গুলোকে হালকাভাবে নেয়নি। আর আমার এই কেসের গোড়া থেকেই উইনগেট সাক্ষী ছিল। যা-ই হোক, এবার আসি আসল ঘটনায়। সেটা ছিল জুলাই মাসের ১৭-১৮ তারিখের একরাতের ঘটনা। বাইরে তুমুল ঝোড়ো হাওয়া বইছিল। আমি ক্যাম্পে তাড়াতাড়ি ফিরে এলেও ঘুম আসছিল না। তখন বোধহয় এগারোটা বেজেছিল, দেখলাম, আর শুয়ে কাজ নেই। যথারীতি সেই নৈশভ্রমণে বেরিয়ে পড়লাম। ক্যাম্প থেকে যখন বেরোচ্ছি, ট্যাপার বলে একজন অস্ট্রেলিয়ান খনি মজুর আমাকে দেখে অভিবাদন জানাল। আকাশে তখন ঝলমলে চাঁদ তার নিজস্ব শোভা নিয়ে বিরাজমান। জ্যোৎস্নায় চারদিক উজ্জ্বল। আমি নিশ্চিত কারও কবিতা লেখার শখ থাকলে তিনি বেশ কয়েক ছত্র কবিতা লিখে ফেলতেন। কিন্তু আমি তো ঘরপোড়া গোরু, তাই কী একটা অশুভ আমাকে যেন ক্রমাগত ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছিল। খেয়াল করলাম, সেই ঝোড়ো বাতাসটা আর তেমন জোরে বইছে না। বুঝলাম, আগামী চার-পাঁচ ঘণ্টার মধ্যে আর ঝোড়ো বাতাস বইবে না। আসলে ট্যাপারদের সঙ্গে কথা বলে এইসব ব্যাপারস্যাপার আমিও বেশ জেনে গিয়েছিলাম। কতক্ষণ হেঁটেছিলাম খেয়াল নেই, তখন বোধহয় সাড়ে তিনটে মতো বেজেছিল। হঠাৎ সেই ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করল। বাতাসের এমনই দাপট ছিল, যে আমাদের ক্যাম্পের সকলের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ঘুম ভেঙে যেতে সবাই দেখল আমি গায়েব। কিন্তু যেহেতু আমি রোজই নৈশভ্রমণে বেরুতাম, কেউ গা করেনি। এদিকে তখনও বাইরে জ্যোৎস্না ঝলমল করছে, আকাশে ছিটেফোঁটাও মেঘ নেই। আমাদের ক্যাম্পের কয়েকজন অস্ট্রেলিয়ান মজুর আবার বেশ কুসংস্কারগ্রস্ত ছিল। তারা মনেপ্রাণে এইসব প্রচলিত উপকথায় বিশ্বাস করত। তাদের ধারণা ছিল, মেঘহীন ঝকঝকে আকাশ থাকা সত্ত্বেও যখন অনেকদিন বাদে এই ঝোড়ো বাতাস বইতে শুরু করবে, সেটা নিশ্চিতভাবে অশুভ। এই বাতাসে কান পাতলে নাকি অনেক অপার্থিব ফিশফিশানি শুনতে পাওয়া যায়। আর এই বাতাসের ফলেই বালির ভেতর থেকে জেগে ওঠে বহু যুগ ধরে মাটির নীচে সুপ্ত থাকা সেইসব রাক্ষুসে আঁকিবুকি-কাটা পাথরের চাঁই। এই সময় তারা ভুলেও ওই এলাকা কখনও মাড়ায় না। তখন আন্দাজ চারটে বাজে, দুম করে ঝোড়ো বাতাস বওয়া বন্ধ হয়ে গেল। আর ঠিক তখনই বালি খুঁড়ে তখন অনেক নতুন আকারের পাথর মাথা তুলেছে।
যখন পাঁচটা নাগাদ চাঁদ পশ্চিমদিকে বিদায় নিল, আমিও টলতে টলতে ফিরে এলাম ক্যাম্পে। আমার মাথায় না-ছিল কোনও টুপি, আর ইলেকট্রিক টর্চটাও গিয়েছিল হারিয়ে। আর আমার চেহারা অবিকল লাশকাটা ঘরের কোনও কাটাছেঁড়া করা লাশের মতোই ফুটিফাটা, শীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। ক্যাম্পের সবাই তখন ঘুমিয়ে পড়লেও অধ্যাপক ডায়ার ক্যাম্পের সামনে বসে জুত করে পাইপ টানছিলেন। আমার চেহারার হাল দেখে তিনি সঙ্গে সঙ্গে ড. বয়েলকে ডেকে আনলেন। তারপর দুজনে মিলে আমাকে ধরাধরি করে নিয়ে গেলেন আমার বিছানায়। এরপর ড. বয়েল, অধ্যাপক ডায়ার আর উইনগেট মিলে আমাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা চালাতে লাগল। কিন্তু আমার তখন যা মানসিক অবস্থা, ওসব ঘুম-টুম তখন বিশ বাঁও জল। হয়তো এযাবৎ আমার মানসিক অবস্থা যতবার বিগড়েছে, এবারেরটা ছিল সব থেকে ভয়াবহ। কিছুক্ষণ বাদে আমি এলোমেলোভাবে আমার হাল কী করে এরকম হল, বর্ণনা দিতে শুরু করলাম। আমি ওদের বললাম যে, আমি ক্লান্ত হয়ে বালির ওপরেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। এবং ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি যেসব ভয়ানক স্বপ্ন দেখেছিলাম তা এযাবৎকাল যত দুঃস্বপ্ন দেখেছি, সব কটাকে টেক্কা দিয়েছিল। অবশেষে যখন আমার স্নায়ু আর দুঃস্বপ্নের ভার বইতে পারেনি, তখন আমি জেগে উঠি। এবং প্রচণ্ড ভয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসার সময় ওই হঠাৎ গজিয়ে-ওঠা পাথরগুলোয়ে ধাক্কা খেয়েই হয়তো আমার শরীর এভাবে কেটে-ছড়ে গেছে। হয়তো আমি একটু বেশিই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তবে একটা কথা মানতেই হবে যে, ওই বীভৎসতার মুখোমুখি হয়েও আমি নিজেকে খুব ভালোভাবে সামলে নিয়েছিলাম। এরপর আমি জানাই, আমাদের অভিযানের কর্মসূচি একটু পালটে যাবতীয় খোঁড়াখুঁড়ির কাজ উত্তর-পূর্বদিক বরাবর করলে ভালো হয়। যদিও আমার কথায় কোনও যুক্তি ছিল না। শুধু কিছু দুঃস্বপ্ন আর অনুমানের ওপর ভিত্তি করে কেউই কর্মসূচি পালটাতে রাজি হয়নি। এদিকে আমাদের অভিযানের পুঁজিও ফুরিয়ে আসছে, আর আমার যা শরীর ও মনের অবস্থা, তাতে কোনও নতুন ঝুঁকি নিতে কেউ রাজি হয়নি, এমনকী উইনগেটও নয়।
পরের দিন ঘুম থেকে উঠে ক্যাম্পের চারদিকে একটু টহল দিলেও ওদের খোঁড়াখুঁড়ির কোনও কাজে কোনও অংশ নিলাম না। দেখলাম, এদের সঙ্গে থাকলে আমার কাজ তেমন এগোবে না। কিন্তু আমাকে কাজ চালিয়ে যেতেই হবে। তাই ঠিক করলাম, আমাকে দেশে ফিরতে হবে। আমার মেজ ছেলে উইনগেটকে বললাম আমার সঙ্গে বিমানে প্রায় হাজার মাইল দক্ষিণ-পশ্চিম পারুথে যাবার জন্য। সঙ্গে এ-ও বললাম, সেখানে পৌঁছোনোর পর যাবতীয় যা কাজ, সব আমি একাই করব। জুলাই মাসের ২০ তারিখ নাগাদ উইনগেট আমার সঙ্গে পারুথে রওনা দিল। ২৫ তারিখ লিভারপুল থেকে স্টিমার ছাড়া অবধি ও আমার সঙ্গে ছিল। এবং স্টিমারের কেবিনে বসে বসেই আমি এই লেখা লিখছি। কারণ আমার মনে হয়েছে, উইনগেটের গোটা ব্যাপারটাই জানা দরকার। বিশেষ করে সেই রাতের ঘটনাটা, যেটা আমি কাউকে বলিনি। আমার দুঃস্বপ্নের প্রতীক সেই নারকীয় হায়ারোগ্লিফিক লেখাওয়ালা সাইক্লোপিয়ান পাথরগুলো যখন পাতাল ফুড়ে আমার সামনে হাজির হয়েছিল, আমার যাবতীয় দুঃস্বপ্ন আর তাদের কেন্দ্র করে আমার গবেষণা সব কিছু নিছকই শিশুসুলভ মনে হয়েছিল। হয়তো আকাশ থেকে জরিপ করার সময় উইনগেট এই পাথরগুলোই দেখেছিল, আর এদের মধ্যে মিল দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। হয়তো আমি যখন এগুলো তেমনভাবে খেয়াল করিনি, কোনও এক অজানা, অশুভশক্তি প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছিল এগুলো আমার দৃষ্টিগোচরে আনতে। আমি আগেই বলেছি, জুলাই মাসের ১৮ তারিখের সেই চাঁদনি রাতে ঝোড়ো বাতাস হঠাৎ করেই থেমে গিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার সেই মরুভূমি আচমকাই সমুদ্রের মতো শান্ত আর স্থির হয়ে গিয়েছিল। যেহেতু আমার এই অভিযানে তেমন কোনও কাজ ছিল না, তাই উদ্দেশ্যবিহীনভাবে এলোমেলো ঘুরে বেড়াতাম। উদ্দেশ্য একটাই, যদি কপালফেরে সেই দুঃস্বপ্নের নগরীর কোনও নিশান খুঁজে পাই! আমরা জানি, আমরা সব থেকে বেশি ভয় পাই অজানা-অচেনাকে। কিন্তু সেই অজানা-অচেনা জিনিস যদি আমাদের চোখের সামনে বারে বারে উঠে আসে, আমাদের ভয় অনেকটাই কমে যায়। আমার ক্ষেত্রে কিন্তু আদৌ তা হয়নি, বরং উলটোটাই হয়েছিল। স্বপ্নের জগতের সেইসব করাল বিভীষিকা যখন স্বপ্নের গণ্ডি পেরিয়ে আমার রোজকার জীবনে হানা দিয়েছিল, আমার জীবন আক্ষরিক অর্থেই হয়ে উঠেছিল দুর্বিষহ। আমার চোখের সামনে প্রাক-মানবসভ্যতার সেইসব ভয়াবহ পাথুরে আতঙ্কপুরীর বালি-আবৃত বারান্দা, খিলান, কুঠুরি বারে বারে ফিরে ফিরে আসত। সঙ্গে অবশ্যই সেইসব হায়ারোগ্লিফিক নকশা। এখানেও কিন্তু আমি ঠিক ওই আতঙ্কপুরীর মতোই বিভিন্ন বালি দিয়ে ঢাকা পাথরের চাঁই দেখতাম। সে দিন ঠিক কতক্ষণ ধরে কোন দিক বরাবর আমি হেঁটেছিলাম, আমার কোনও খেয়ালই ছিল না। তাই যখন আমি হাঁটতে হাঁটতে ওই পাথরের চাঁইগুলোর কাছে সে দিন পৌঁছোলাম, আমার বুকের ভেতর দামামা বাজতে লাগল। কারণ একসঙ্গে এতগুলো পাথরের চাঁই আমি এখনও পর্যন্ত দেখিনি। আকাশের চাঁদ আর মরুভূমিকে এখন আর সৌন্দর্যের প্রতীক মনে হচ্ছিল না, বরং মনে হচ্ছিল অগণিত বছর ধরে কোনও অন্ধ অতীতের সাক্ষী এরা।