এক মাস ধরে খোঁড়াখুঁড়ি চালাবার পর নানারকম আকৃতির প্রায় ১২৫০টা পাথরের চাঁই আমরা খুঁজে পেলাম। বেশির ভাগই ছিল ওপর-নীচে ঢেউ-খেলানো মান্ধাতার আমলের খোদাই-করা স্মৃতিস্তম্ভের মতো। কিছু ছিল আমার স্বপ্নে দেখা ওই পাষাণপুরীর মেঝে আর রাস্তার ধারের ফুটপাথের মতোই চৌকোনা বা আটকোনা চ্যাটালো ছোট পাথর। কয়েকটা আবার দানবীয় আকারের পাথরও ছিল। আমরা উত্তর-পূর্ব দিক বরাবর যত খোঁড়াখুঁড়ি চালাতে লাগলাম, ক্রমাগত এরকম পাথরের নমুনা আরও চোখে পড়তে লাগল। যদিও এযাবৎ আবিষ্কৃত সব কটা পাথরের মধ্যে কোনওরকম যোগসূত্র আছে কি না, সেটা আমরা বের করতে পারিনি। অধ্যাপক ডায়ার এই পাথরগুলোর প্রাচীনত্ব দেখে হতবাক হয়ে গেলেন। তবে অধ্যাপক ফিবরন অবশ্য কিছু চিহ্নের সঙ্গে পাপুয়ান আর পলিনেশীয় ভয়ানক কিছু প্রচলিত কিংবদন্তির মিল খুঁজে পেলেন। তবে পাথরগুলোর অবস্থা দেখে আমরা সকলেই একটা বিষয়ে একমত ছিলাম, এগুলো বহু যুগের বিবর্তনের সাক্ষী।
আমাদের সঙ্গে যে এরোপ্লেন ছিল, আমার মেজ ছেলে উইনগেট তাতে চেপে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন উচ্চতা থেকে জরিপ করে মরুভূমির বালি আর পাথরগুলোর মধ্যে নতুন কোনও চিহ্ন বা সূত্র খুঁজে দেখার চেষ্টা চালাত। অবশ্য তার এই চেষ্টা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করেই একদিন সে সাফল্যের মুখ দেখল। ঝোড়ো হাওয়ার ফলে বেশ কিছু বালি এক জায়গা থেকে সরে অন্য জায়গায় চলে গিয়েছিল। আর তার ফলেই তার চোখে পড়ল নতুন এক পাথরের ছাঁদ। আর এইগুলোর মধ্যে দু-একটা দেখার পরই আমি চিনতে পারলাম এই ছাঁদগুলোকে। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছিলাম না, হুবহু। কোথায় এগুলোকে আমি দেখেছিলাম। হতে পারে, আমার সেই নারকীয় দুঃস্বপ্ন অথবা দিনরাত পড়াশোনা আর গবেষণার ফলেই হয়তো অবচেতন মনে এর ছাপ রয়ে গেছে।
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ নাগাদ আমি প্রথম সেই অজানা উত্তুরে ভয়ানক বাসিন্দাদের সম্পর্কে ভয় আর কৌতূহল মেশানো একটা অদ্ভুত গা-শিরশিরে অনুভূতি টের পেলাম। হয়তো এর জন্য কিছুটা দায়ী ছিল আমার আগের ভয়ানক অভিজ্ঞতার স্মৃতি। আমি মাথা থেকে এইসব চিন্তা হটাবার জন্য নিজেকে নানারকম মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে শুরু করলাম। কিন্তু সবই বিফল হল। এই সময় গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো যোগ হল অনিদ্রা। তবে এটা আমার কাছে তেমন কোনও অসুবিধে হয়নি, কারণ ঘুমোলেই তো আবার ওইসব স্বপ্ন দেখতে হবে! সে যা-ই হোক, এই সময় আমার একটা নতুন অভ্যাস তৈরি হল। সেটা হল গভীর রাতে উত্তর বা উত্তর-পূর্ব দিক বরাবর মরুভূমিতে হাঁটা। কেন জানি না মনে হত, হয়তো আমার বহু আকাঙ্ক্ষিত দুঃস্বপ্ন নগরীর বা তার বাসিন্দাদের দেখা পেলেও পেতে পারি। নিজের ইচ্ছা থাক বা না-থাক, কেউ যেন জোর করে আমাকে টেনে নিয়ে যেত ওই নৈশভ্রমণে। ঘুরতে ঘুরতেই কখনও কখনও হোঁচট খেতাম মাটি থেকে সামান্য উঁকি-মারা সেই আদ্যিকালের স্থাপত্যের কিছু পাথরের টুকরোয়। কিন্তু সেগুলো সংখ্যায় খুব বেশি ছিল না। যদিও আমার বিশ্বাস ছিল, মাটির নীচে এই স্থাপত্যের সিংহভাগই বহু যুগ ধরে লুকিয়ে রয়েছে। তার কারণও ছিল অবশ্য। আমাদের ক্যাম্পটা ছিল ওই পাথুরে টুকরোগুলোর থেকে উঁচু জায়গায়। বালির ঝড়ের দৌলতে একটা সাময়িক টিলার সৃষ্টি হয়েছিল। আর টিলার জন্যই অপেক্ষাকৃত নতুন পাথরের টুকরোগুলো কিছুটা মাথা বের করেছিল।
এই গোটা এলাকার খোঁড়াখুঁড়ি চালালে ঠিক কী কী আবিষ্কার হতে পারে, তার জন্য আমি আর কৌতূহল চেপে রাখতে পারছিলাম না। এই নৈশভ্রমণের ফলেই আমি একদিন আবিষ্কার করলাম এক ভয়ানক জিনিস। সেটা ছিল জুলাই মাসের ১১ তারিখ। জ্যোৎস্নায় ঝলমলে হয়ে ছিল গোটা এলাকাটা। আমিও নিজের নৈশভ্রমণের এক্তিয়ার পেরিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলাম আরও খানিকটা। এবং ঘুরতে ঘুরতেই আমার চোখে পড়েছিল একখানা রাক্ষুসে পাথরের চাঁই। পাথরটা প্রায় পুরোটাই বালিতে ঢেকে গিয়েছিল। আমি ভালোভাবে দেখার জন্য দু-হাত দিয়ে সব বালি পরিষ্কার করলাম। তারপর চাঁদের আলো আর আমার ইলেকট্রিক টর্চের যুগলবন্দিতে ভালোভাবে দেখতে লাগলাম পাথরটা। একেবারে নিখুঁত বর্গাকার এই পাথরটা ছিল আমাদের অভিযানে আগে দেখা সব কটা পাথরের থেকে এক্কেবারে আলাদা। ব্যাসাল্টজাতীয় শিলা দিয়ে তৈরি এই পাথরের চাঁইটায় কোনও উত্তল বা অবতল অংশ ছিল না। আর তখনই আমার মাথায় একটা ঝলক দিল! ঠিক এইরকম পাথরগুলোকেই আমি আমার স্বপ্নে দেখতাম। ইথদের দুনিয়ায় আমি যে জানলাহীন পেল্লায় পাথুরে বাড়িগুলো দেখতাম, এই পাথরটা সেই বাড়িগুলোরই একটা অংশ। এই বাড়ির মধ্যেই পাতাল-কুঠুরিতে চিরকালের জন্য দরজার মুখ বন্ধ করে রেখে দেওয়া হত কোনও অপার্থিব শক্তিকে। আর দেরি নয়, দৌড় লাগালাম আমাদের ক্যাম্পের দিকে। সে রাতে আর ঘুম এল না আমার। ভোরবেলা বুঝতে পারলাম, কী বোকামিটাই না করেছি! একটা মান্ধাতার আমলের উপকথা আর আমার দুঃস্বপ্নের ভিত্তিতে ওভাবে ভয় পাওয়াটা আমার উচিত হয়নি। একটু বেলা হলে আমি সবাইকে আমার আবিষ্কারের কথা বললাম। তারপর সবাই মিলে একসঙ্গে রওনা দিলাম পাথরটাকে দেখার জন্য। কিন্তু আমার কপালটাই বোধহয় খারাপ ছিল। গত রাতে বালির ঝড়ে গোটা এলাকাটা ঢাকা পড়ে গেছে, ফলে আমি ঠিক কোন জায়গাটায় ওই পাথরটাকে দেখেছিলাম, খুঁজে বের করতে পারলাম না।