১৯৩৪ সালের ১০ জুলাই আমার হাতে এল সুদূর অস্ট্রেলিয়ার পিলবারা থেকে পাঠানো একটা চিঠি আর তার সঙ্গে কিছু ফোটোগ্রাফ আর কাগজপত্র। আর এই চিঠিটাই আমার সামনে তুলে ধরল সেই নারকীয় রহস্য উন্মোচনের এক অভাবনীয় সুযোগ। বেশি কিছু না বলে সরাসরি সেই চিঠির বয়ান হুবহু তুলে দিলাম:
অধ্যাপক ন্যাথানিয়েল উইনগেট পিসলি,
৪৯, ডাম্পিয়ের স্ট্রিট,
প্রযত্নে, মনোবিজ্ঞান বিভাগ।
পিলবারা, পশ্চিম অস্ট্রেলিয়া,
৩০ই. ৪১ স্ট্রিট,
১৮ মে, ১৯৩৪
নিউ ইয়র্ক সিটি, ইউএসএ
মাননীয়েষু,
প্রথমেই জানিয়ে রাখা ভালো যে, আপনার সঙ্গে আমার সরাসরি কোনও পরিচয় নেই। কিছু দিন আগে পার্থ নিবাসী ড. ই এম বয়েলের সঙ্গে আমার বিভিন্ন বিষয়ে কথা হচ্ছিল। কথাপ্রসঙ্গে তিনি আপনার কথা অর্থাৎ আপনার ওই দ্বৈত সত্তা নিয়ে কাগজে বিভিন্ন লেখালেখির কথা আমাকে বলেন। তিনি আমাকে এ-ও জানান যে, আপনি আপনার স্বপ্ন নিয়ে বিভিন্ন নিবন্ধ লিখেছেন। এই বিষয়ে আমি আগ্রহ প্রকাশ করায় তিনি আমাকে বলেন যে, ডাকযোগে তিনি আমাকে সেগুলো পাঠাবার ব্যবস্থা করতে পারেন। ক-দিন আগে তিনি আপনার লেখা বিভিন্ন নিবন্ধ, কিছু কাগজ ও ছবি আমাকে ডাকযোগে পাঠান। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো যে, আমি পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার আর সরকারি খনি বিভাগের সঙ্গে জড়িত। আপনি হয়তো শুনলে অবাক ও আশ্বস্ত হবেন যে, আপনার স্বপ্নে দেখা বিভিন্ন জ্যামিতিক আঁকিবুকি আর অদ্ভুত ওইসব বিরাট পাথরের চাঁইয়ের কিছু নমুনা আমিও দেখেছি।
কীভাবে দেখলাম, এবার সেই কথা বলি। বছর দুয়েক আগে সোনার খনির কাজে আমাকে যেতে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার মরুভূমিতে। কাজের জন্য সেখানকার আদিবাসীদের সাহায্য নিতেই হয়। এই আদিবাসীদের মুখেই প্রথম শুনি নানারকম অদ্ভুত প্রচলিত কিংবদন্তির কথা, যার মধ্যে একটা ছিল এক অজানা প্রাচীন শহরের কথা, যেখানে নাকি ওইরকম পেল্লায় পাথরের চাঁই দেখা যায়, যেগুলোর গায়ে থাকে অদ্ভুত নকশা আর আপনার বর্ণনার সেইসব হায়ারোগ্লিফ। স্থানীয় এইসব আদিবাসী যে কুসংস্কারগ্রস্ত হবে তা বলাই বাহুল্য, কিন্তু যেটা দেখলাম, এই কিংবদন্তি নিয়ে তাদের মধ্যে এক অজানা চাপা আতঙ্ক। তারা আবার আরও এক ধাপ এগিয়ে এর সঙ্গে নিজেদের কিছু চালু উপকথাকেও মিলিয়ে নিয়েছে। যেমন বুদ্দাই নামে এক বিশালাকার বৃদ্ধ, যে কিনা যুগ যুগ ধরে নিজের হাতের ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে। যে দিন সে জেগে উঠবে, তার আগ্রাসী খিদে নিয়ে খেয়ে ফেলবে গোটা দুনিয়াকে। আর যেখানে সে ঘুমিয়ে আছে, তার আশপাশেই দেখা যায় ওইসব রাক্ষুসে পাথরের চাঁই।
এই পাথরগুলো নাকি যেখানে আছে, তার নীচেই আছে এক ভয়ংকর দুনিয়া, যার বিস্তার কত দূর তা কেউ জানে না। এই দুনিয়া কতটা ভয়াবহ তা এই আদিবাসীদের কাছে অজানা হলেও এর প্রসঙ্গ উঠলেই তারা ভয়ে কুঁকড়ে যায়। কারণ তারা নাকি শুনেছে, বহু যুগ আগে কিছু সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেয় এইরকমই এক সুড়ঙ্গের ভেতর, আর এরপর তারা কেউই আর ফিরে আসেনি। কিন্তু তাদের আশ্রয় নেবার পর থেকেই ওই জায়গা দিয়ে বইতে শুরু করে ভয়ানক ঝোড়ো বাতাস। আমি এদের এইসব আষাঢ়ে গল্পে তেমন পাত্তা না দিলেও, আমার মনে গেঁথে আছে বছর দুয়েক আগের সেই স্মৃতি।
বছর দুয়েক আগে এই মরুভূমিরই ৫০০ মাইল পূর্বে আমি এরকমই কিছু রাক্ষুসে পাথরের চাঁই দেখেছিলাম। প্রায় ১২ ফুট লম্বা এই চাঁইগুলো মাটিতে পোঁতা ছিল। প্রথমে কিন্তু আমি এগুলোর গায়ে কোনও চিহ্ন দেখতে পাইনি, কিন্তু একটু কাছে গিয়ে ভালোভাবে দেখার পর এর গায়ে গভীরভাবে খোদাই-করা অদ্ভুত কিছু আঁকাবাঁকা রেখা দেখতে পাই, ঠিক যেমনটি ওই আদিবাসীরা তাদের আষাঢ়ে গপ্পে বলেছিল। কেন জানি না আমার মনে হল, মাইলখানেকের মধ্যে এরকম আরও ৩০-৪০টা পাথরের চাঁই পোঁতা থাকলেও থাকতে পারে। আমার যন্ত্রপাতির সাহায্যে একটু খোঁজার পর দেখলাম ঠিক তা ই। খুঁজে পেলাম এরকম আরও কয়েকটা চাঁই, এবং সেগুলোর কাছে গিয়ে ভালো করে পরীক্ষা করলাম। এবং আশ্বস্ত হবার পর দশ-বারোটা ছবিও তুললাম। ছবিগুলো এই চিঠির সঙ্গেই আপনাকে পাঠিয়েছি। এর আগে অবশ্য আমি এই চিঠি আর তথ্যগুলো পারথের সরকারি বিভাগেও পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু তারা এগুলোতে কোনও পাত্তাই দেয়নি। এরপর আমার সঙ্গে আলাপ হয় ড. বয়েলের। এই ড, বয়েল আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল সোসাইটির জার্নালে আপনার নিবন্ধগুলো পড়েছিলেন। আমি তাঁকে এই পাথরের চাঁইগুলোর কথা বলতেই তিনি প্রচণ্ড উৎসাহিত হয়ে পড়েন। আমি তাঁকে এ-ও জানাই যে, এই পাথর আর এর গায়ে আঁকা নকশাগুলোর সঙ্গে আপনার স্বপ্নে দেখা নকশাগুলোর যথেষ্ট মিল আছে। সঙ্গে আমি তাঁকে আমার তোলা ছবিগুলোও দেখাই। এরপরেই তিনি আমাকে বলেন অবিলম্বে আপনার সঙ্গে চিঠিতে যোগাযোগ করার জন্য। আমার এই চিঠিটা পাঠাতে একটু দেরি হল, কারণ ইতিমধ্যে ড. বয়েল আমাকে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত আপনার প্রায় সব প্রবন্ধ নিবন্ধ আমাকে পাঠান, আমি আরও একবার সমস্ত আঁকা আর বর্ণনাগুলো ভালোভাবে মিলিয়ে নিলাম এবং দেখলাম, ঠিক যেমনটি আপনি বলেছেন, আমার এই ছবিগুলোও সেইরকমই। এবং ওই পত্রপত্রিকার কপি আর যাবতীয় তথ্য ইত্যাদিও চিঠির সঙ্গে পাঠালাম। বাকিটা না-হয় ড. বয়েলের থেকে সরাসরি সাক্ষাতেই শুনে নেবেন। সত্যি কথা বলতে কী, এগুলো দেখার পর আমি বুঝতে পারলাম, এগুলো আপনার কাছে ঠিক কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। আমি আগেই বলেছি, একজন মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার দরুন ভূতত্ত্ব সম্পর্কে অল্পবিস্তর পড়াশোনা আমার আছে। সেই নিরিখেই বলতে পারি, এই পাথরের চাঁইগুলো এতটাই প্রাচীন যে, সাধারণ ভূতত্ত্বের জ্ঞান দিয়ে এগুলোর আনুমানিক বয়স বলা অসম্ভব। তবে এটুকু বলতে পারি, পৃথিবীর গঠনের সময়ও এই পাথরগুলোর অস্তিত্ব ছিল। এই পাথরগুলোর উপাদান হিসেবে থাকা কংক্রিট আর সিমেন্টের উপাদান রীতিমতো বিস্ময়কর। এবং আরও বুঝতে পারি, বহু দিন, হয়তো সহস্র-লক্ষাধিক বছর কিংবা তারও বেশি দিন এগুলো জলের তলায় ডুবে ছিল। এবং বহু যুগের বিবর্তনের সাক্ষী এই পাথরের চাঁইগুলো। আর এগুলো বারে বারে ব্যবহৃত হয়েছে। ঠিক কত দিন, আমি বলতে পারব না। সত্যি বলতে কী, ভাবতেও চাই না। তবে একটা ব্যাপারে আমি নিশ্চিত, আমরা দুজনেই মুখোমুখি হয়েছিলাম বহু প্রাচীন এক সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের।