ঠিক সেই সময় আমি একটা নতুন শব্দ শুনতে পেলাম। একনাগাড়ে চলতে থাকা একটা সুর। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে অনেক দূরের কোনও জগৎ থেকে ভেসে-আসা একঘেয়ে গুঞ্জন নাকি গজরানি– আকাশের উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে ভেসে আসছে কার আহ্বান!
এরপর আমি এমন চিৎকার করে উঠেছিলাম যে, পুলিশ ও বাড়িওয়ালা এসে ঘরের দরজা ভাঙতে বাধ্য হয়। কিন্তু সেই দূরের একঘেয়ে গুঞ্জনের এত ক্ষমতা ছিল না যে, আমাকে একেবারে দখল করে ফেলে আমার বুকের মধ্যে চিরকালীন ভয়ের জলছাপ হয়ে উঠবে। আমার চিৎকারের কারণ ছিল অন্য কানে ভেসে আসা কোনও গুঞ্জন নয়, চোখে দেখা এক দৃশ্য। আমি দেখেছিলাম আকাশের অন্ধকারাচ্ছন্ন উত্তর-পূর্ব কোণ থেকে অন্ধকার, বন্ধ দরজার আড়ালে থাকা ঘরের মধ্যে এসে পৌঁছেছে ভয়ংকর এক লাল ও সোনালি-মেশানো আলোকরশ্মি। এমন এক রশ্মি, যা ঘরের অন্ধকারকে ভেদ করছে না। সে কেবল বিচ্ছুরিত হচ্ছে ঘরের কোণের নিদ্রিত মানুষটির মুখমণ্ডল থেকে। আমার বন্ধুর মুখটা এখন অবিকল পুরোনো সময়ের মতো দেখাচ্ছে, যখন আমরা সময় আর স্পেসের শিকল ভেঙে কোন সুদূরে ভেসে গিয়েছিলাম এক গোপন, নিষিদ্ধ দুঃস্বপ্নের গুহায়। তখনও স্বপ্নের গভীরে তার তারুণ্যে ভরা মুখে আমি এমনই আলো ফুটে থাকতে দেখেছিলাম।
আমি দেখলাম, আমার বন্ধুর কালো, ঘন, আয়ত চোখে ফুটে উঠেছে আতঙ্ক। তার পাতলা, ছায়াচ্ছন্ন ঠোঁট ধীরে ধীরে ফাঁক হচ্ছে। মনে হল, সে ভয়ে চিৎকার করে উঠতে চাইছে। কিন্তু আতঙ্ক এমনভাবে তাকে গ্রাস করেছে, তার গলায় কোনও স্বর ফুটে উঠছে না। অন্ধকারে অদৃশ্য হয়েছে তার দেহ, কেবল জেগে আছে মাথাটুকু। কেঁপে কেঁপে উঠছে। সেই আতঙ্কিত মুখে জেগে রয়েছে তীব্র, মগজ অবশ করে দেওয়া ভয়ের জলছাপ।
কোথাও কোনও শব্দ নেই। কেবল সেই অমানুষিক গজরানি ক্রমেই বেড়ে উঠছে। বন্ধুর আতঙ্কিত দৃষ্টি অনুসরণ করে আমিও তাকালাম অভিশপ্ত সেই সোনালি-লাল আলোর উৎসের দিকে। আর দেখলাম… ওহ্! এক লহমার জন্য আমি যা দেখেছিলাম আর শুনেছিলাম, তার অভিঘাতেই আমার কণ্ঠস্বর চিরে বেরিয়ে এসেছিল তীব্র আর্তনাদ। সেই চিৎকার এমনই তীব্র ছিল, ছুটে এসেছিল পুলিশ ও বাড়িওয়ালা।
আমি কখনও কাউকেই বলতে পারিনি আমি কী দেখেছিলাম। চেষ্টা করেও পারিনি। সেই স্বপ্নতাড়িত মানুষটিও পারেনি। আমি নিশ্চিত, আমি যা দেখেছিলাম, ও তার থেকেও অনেক, অনেক বেশি কিছু দেখেছিল। ও আর কখনওই কথা বলবে না। কিন্তু আমি চিরকাল পাহারা দিয়ে যাব ওকে, অনন্ত জ্ঞান ও দর্শনের পিপাসু, চির-অতৃপ্ত ঘুমের দেবতা হিপনোসকে।
ঠিক কী ঘটেছিল সেই রাত্রে, তা আমার কাছে অজানাই রয়ে গেছে। মনের ভেতরে জেগে-ওঠা ভয়ানক সব দৃশ্যের অভিঘাতে আমি এলোমেলো হয়ে গিয়েছিলাম। বাকিরাও কেউ কিছুই বলতে পারেনি। ওদের আচরণে স্পষ্ট, ওরা পুরো ব্যাপারটাই আমার পাগলামি বলে ধরে নিয়েছে। ওরা আমাকে বলেছে, আমার কোনও দিনই কোনও বন্ধু ছিল না। শিল্প-দর্শনে ঝুঁদ হয়ে থাকার পাগলামিতেই নাকি আমার জীবনের এমন করুণ পরিণতি!
সেই রাতে বাড়িওয়ালা, পুলিশ– সবাই আমাকে অনেকক্ষণ ধরে শান্ত করার চেষ্টা করেছিল। ডাক্তার এসে আমাকে ওষুধ দিল, যাতে আমি শান্ত হতে পারি। আমার বন্ধুকে নিয়ে ওদের কোনও মাথাব্যথা ছিল না। ওরা স্টুডিয়োর এক কোণ থেকে উদ্ধার করেছিল একটা মূর্তি, যার জন্য প্রচুর প্রশংসা জুটেছিল আমার কপালে। পরবর্তী সময়ে খ্যাতিও পেয়েছি প্রভূত। একসময় যে খ্যাতির আশাকে হেলায় সরিয়ে দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বুঁদ হয়ে থেকেছি এক ধূসর দাড়িময়, বলিরেখায় ঢাকা মুখের সামনে। ভালোবাসা ও প্রার্থনায় মগ্ন থেকেছি তার সামনে।
আমি আমার বানানো সব মূর্তি বিক্রি করে দিয়েছি এ কথা ওরা বিশ্বাস করতে রাজি ছিল না। অবিশ্বাসে মাথা নেড়ে ওরা দেখাচ্ছিল ঘরের কোণের মূর্তিটার দিকে। কী করে ওদের বোঝাই, ওটা আমার বন্ধুর দেহাবশেষ। এক অজানা জগৎ থেকে ভেসে-আসা আলোয় যে বন্ধু চিরকালের মতো অনড়, শীতল, নীরব হয়ে গিয়েছে। সেই বন্ধু, যার সঙ্গে দিনের পর দিন আমি মেতে উঠেছিলাম এক আশ্চর্য পাগলামিতে। যার ঈশ্বরপ্রতিম দেবদুর্লভ শ্বেতপাথরের মুখশ্রীতে লেগে আছে চিরতারুণ্যের জলছাপ। ঠোঁটে লেগে মৃদু বাঁকা হাসি। সুবিন্যস্ত দাড়ি, ঢেউখেলানো চুল।
ওদের দাবি, ওই মুখ আসলে আমারই আদলে তৈরি। আমারই মতো বছর পঁচিশেকের এক তরুণকে আমি তিলে তিলে নির্মাণ করেছি পাথর কুঁদে কুঁদে। কিন্তু ওরা খেয়াল করেনি ওই মুখের চারপাশে যে শ্বেতপাথরের পশ্চাৎপট, তাতে খোদাই-করা একটা নাম। অ্যাটিকা হরফে লেখা যে নামটি প্রাচীন গ্রিসের উপাস্য ঘুমের দেবতার– হিপনোস।
[প্রথম প্রকাশ: গল্পটি ১৯২৩ সালের মে মাসে, দ্য ন্যাশনাল অ্যামেচার ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়।
ভাষান্তর: বিশ্বদীপ দে ]