সে আমাকে পরামর্শ দিল, এবার থেকে যতটা সম্ভব কম করে ঘুমোতে হবে আমাদের। তার জন্য ড্রাগের আশ্রয় নিতে হলে তা-ই সই। কিন্তু ঘুমের রাস্তায় যাতায়াত কমাতেই হবে। সে যে ভুল বলেনি তা আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। ঘুমিয়ে পড়লেই এক অবর্ণনীয় দুঃস্বপ্ন গ্রাস করে নিচ্ছিল আমাকে। প্রতিটা ছোট ও অনিবার্য ঘুমের ভেতরেই আমার বয়স বেড়ে যাচ্ছিল দ্রুত! কিন্তু আমার বন্ধুর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আরও অদ্ভুত হয়ে উঠল। সে চোখের সামনে বুড়িয়ে যাচ্ছিল! রাতারাতি তার মুখে বলিরেখা গজিয়ে উঠল, চুল হয়ে উঠল সাদা।
আমাদের জীবনটা বদলে গেল। আমার সেই বন্ধু, যার আসল নাম বা পরিচয় সে কখনও মুখ ফুটে বলেনি, সে ক্রমে বিচ্ছিরি রকমের খিটখিটে হয়ে উঠল। আসলে সে একা থাকতে ভয় পাচ্ছিল। বিশেষত, রাত হলে সে একা থাকতেই চাইত না। বেশ কয়েকজন মানুষের সান্নিধ্যও তাকে প্রশান্তি দিতে পারছিল না। অচেনা মানুষদের সঙ্গেও আমরা মেলামেশা করছিলাম। অকালে বুড়োটে মেরে-যাওয়া আমাদের চেহারা অন্যদের মনে বিশ্রী কৌতূহলের জন্ম দিত। আমার সেটা একেবারেই ভালো লাগত না। কিন্তু আমার বন্ধুর তাতে অসুবিধা ছিল না। অন্তত একা থাকার চেয়ে লোকের ভিড়ে থাকাটাই তার কাছে শ্ৰেয় ছিল, যতই তারা আমাদের কৌতূহলের চোখে দেখুক না কেন।
ঘরের বাইরে কক্ষনো একা একা বেরোতে চাইত না সে। বিশেষ করে রাতে, তারা ঝলমলে আকাশের নীচে একলা যেতে তার তীব্র আপত্তি ছিল। ঠেলেঠুলে বের করলে দেখতাম, ভয়ে ভয়ে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। তার চোখে এমন ভয়ের জলছাপ লেগে থাকত, যেন আকাশের শরীরে কোনও ভয়ংকর জেগে রয়েছে। সে আকাশের একই দিকে তাকাত, এমন নয়। বিভিন্ন সময় আকাশের বিভিন্ন কোণে আটকে থাকত তার ভয়ার্ত দৃষ্টি। বসন্তকালে সে তাকাত উত্তর-পূর্ব আকাশের দিকে। গ্রীষ্মে দেখত ঠিক মাথার ওপরে থাকা আকাশের দিকে। শরৎকালে তার দৃষ্টি ঘুরে যেত উত্তর-পশ্চিমে। শীতকালে সেটা চলে যেত পুব আকাশে, তবে ভোরের দিকে। শীতের মাঝামাঝি সময়ে তার চোখে ভয়ের মাত্রা কমে আসত।
বছর দুয়েক কাটার পরে আস্তে আস্তে ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট হল। আমি বুঝতে পারছিলাম, আকাশের দিকে তাকানোর সময়ে আসলে সে নির্দিষ্ট কোনও নক্ষত্রপুঞ্জের দিকে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে। সেই নক্ষত্রপুঞ্জ যেমন যেমন সরছে, আকাশে তার দৃষ্টিও সেইভাবেই বদলে বদলে যাচ্ছে। তার দৃষ্টি অনুযায়ী আকাশের দিকে দেখতে দেখতে আমার ধারণা হল, করোনা বোরিয়ালিসের দিকেই তাকায় আমার বন্ধু।
আমরা এখন লন্ডনের একটা স্টুডিয়োতে থাকি। দুজনের কেউই সেই দিনগুলোর কথা ভুলেও উচ্চারণ করি না। অজানা জগতের ভয়াল রহস্যের খোঁজে বেরিয়ে পড়ার সময়টা এখন কেমন অলীক বলে মনে হয়। যত দিন যাচ্ছে, আমরা আরও বুড়ো আর দুর্বল হয়ে যাচ্ছি। নিয়মিত ড্রাগসেবন আর স্নায়বিক দৌর্বল্যেরই ফল এই অকালবার্ধক্য। লম্বা ঘুমের থেকে অবশ্য ছুটি মিলেছে। কিন্তু দু-এক ঘণ্টার ঘুমও আমাদের কাছে আতঙ্কের কালো ছায়া নিয়ে আসে।
জানুয়ারি মাস। বৃষ্টি আর কুয়াশাচ্ছন্ন চারপাশ। পকেট একেবারে ফাঁকা। ড্রাগ কেনার পয়সা জোগাড় করা মুশকিল। যেসব মূর্তি বানিয়েছিলাম, সবই বিক্রি হয়ে গেছে। নতুন করে মূর্তি বানাব, মালমশলা কেনার সাধ্যও নেই। সত্যি বলতে কী, উৎসাহও নেই। ভয়ংকর খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা।
এরপরই এল সেই রাত৷ স্পষ্ট মনে আছে সেই রাতটার কথা। লক্ষ করলাম, আমার বন্ধু ঘুমোচ্ছে। একেবারে অঘোরে। জাগাতে গিয়েও পারলাম না। জনশূন্য, অন্ধকারময় স্টুডিয়ো। বাইরে বৃষ্টিপতনের ছন্দময় ধ্বনি। বড় ঘড়ির টিক টিক শব্দটা প্রচণ্ড হয়ে উঠেছে এই নিস্তব্ধতার ভেতরে। এমনকী, ড্রেসিং টেবিলের ওপরে রাখা আমাদের শৌখিন ঘড়ির মৃদু টিক টিকও শোনা যাচ্ছে। বাড়ির অন্যত্র কেউ ক্যাঁচ শব্দে দরজা খুলল। দূরে বৃষ্টি ও কুয়াশা-মাখা শহরের শব্দ। আর সব কিছুকে ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে আমার ঘুমন্ত বন্ধুর গভীর শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ। সেই নিশ্বাসের ভেতরে মিশে রয়েছে যেন কোনও অশুভ দুনিয়ার ছায়া। ছন্দময় শ্বাসক্রিয়ার গভীরে অমানুষিক আতঙ্ক ও যন্ত্রণা লুকিয়ে আছে। বুঝতে পারছিলাম, ঘুমের গভীরে স্বপ্নের পথে সে পৌঁছে গিয়েছে সেই নিষিদ্ধ, অকল্পনীয়, অসহনীয় ব্রহ্মাণ্ডের ভেতরে।
জেগে থাকাটা আমার কাছে অসহ্য হয়ে উঠতে লাগল। বিপর্যস্ত মনের মধ্যে নানারকম ছবি ভেসে উঠতে লাগল। শুনতে পেলাম, কোথায় যেন কোনও ঘড়িতে ঘণ্টা বাজার শব্দ হচ্ছে। এ ঘড়ি আমাদের ঘড়ি নয়। কেননা, ওরকম শব্দ-করা কোনও ঘড়ি আমাদের নেই। আমার বিষণ্ণ কল্পনায় স্পষ্ট অনুভব করলাম, ওই ঘণ্টার শব্দ আসলে কোনও দীর্ঘ সফর শুরুর সংকেত। ঘড়ি– সময়– স্পেসঅসীম– বহু দূরে তলিয়ে যেতে যেতে কল্পনার স্রোত আবার আমাকে ঘরের মধ্যে নিয়ে এল। আমি অনুভব করলাম, এই ছাদ, কুয়াশা, বৃষ্টি, আবহাওয়ামণ্ডলের অন্তরালে আকাশের উত্তর-পূর্বে জেগে উঠেছে করোনা বোরিয়ালিস! হ্যাঁ, সেই করোনা বোরিয়ালিস। আমার বন্ধুর চেতনায় যে প্রবল ভয়ংকর অজানা জগতের দূত। তার অর্ধবৃত্তাকার শরীর জুড়ে ফুটে রয়েছে উজ্জ্বল তারারা।