আমরা যেন ভেসে যাচ্ছিলাম। কিংবা বলা যায়, উড়ে চলেছিলাম। আমাদের মনের একটা অংশের সঙ্গে চিরচেনা বাস্তব দুনিয়ার সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। মনের সেই টুকরো যেন প্রতিমুহূর্তে ধাওয়া করে চলছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন, প্রবল ভয়াল কোনও নারকীয় জগৎকে। যেতে যেতে মাঝেমধ্যে আশ্চর্য থকথকে পদার্থের তৈরি সব প্রাচীরকে ভেদ করে এগোতে হচ্ছিল। যেন জমাট-বাঁধা বাষ্প দিয়ে তৈরি। কিংবা বলা ভালো, মেঘের শরীরের উপাদান দিয়ে সেই প্রাচীরগুলি তৈরি।
শরীরহীন, অন্ধকার সেই যাত্রাপথে আমরা কখনও একসঙ্গে ছিলাম। কখনও-বা একদম একলা। যখন একসঙ্গে এগোচ্ছিলাম, টের পাচ্ছিলাম, আমার বন্ধু আমার থেকে অনেক এগিয়ে রয়েছে। আমি কেবল তার উপস্থিতির আন্দাজ পাচ্ছিলাম। এক অপার্থিব সোনালি ছমছমে আলোয় তার ধবধবে ভুরু, জ্বলজ্বলে চোখ, অন্ধকার চুল-দাড়ির আভাস ঝলমল করে উঠে আমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল তার উপস্থিতি।
আমাদের কাছে সময়ের কোনও হিসেব ছিল না। সময় যেন আমাদের কাছে হয়ে উঠল এক অলীক মায়া। পুরো ব্যাপারটাই যে অস্বাভাবিক, সেটা দিব্যি বুঝতে পারছিলাম। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপারটা হল, আমাদের বয়স গেল থমকে!
আমরা কথা বলতাম ফিশফিশ করে। গোপনীয় আর উচ্চাকাঙ্ক্ষায় ভরা সব কথা। কোনও দেবতা বা শয়তানেরও কল্পনার অতীত, এমন সব পরিকল্পনা আমাদের আলোচনায় ভেসে বেড়াত। তবে জোরে স্পষ্ট গলায় সেসব বলতে পারতাম না। কথা বলতে গেলেই যেন কেঁপে উঠতাম। আমার বন্ধু একবার একটা কাগজে লিখে বসল তার ইচ্ছের কথা, যা মুখে বলার সাহস তার ছিল না। আমি সঙ্গে সঙ্গে সেই কাগজটা আগুনে পুড়িয়ে ফেললাম। তারপর ভয়ে ভয়ে উঁকি দিলাম জানলার বাইরে। শিউরে উঠে তাকিয়ে রইলাম তারা-ঝলমলে রাত্রির আকাশের দিকে। ওর লেখাটা ভালো করে দেখিনি। তবে যেটুকু দেখেছিলাম, তাতে আন্দাজ করতে পারি… কেবল আন্দাজ… আমার বন্ধু পাতায় ফুটিয়ে তুলছিল একটা নকশা। যে নকশা আমাদের চোখে দেখা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্ত্রক। সেই নকশাই নিয়ন্ত্রণ করে সমস্ত গ্রহনক্ষত্রের গতিবিধি। এবং জীবজগতের সমস্ত প্রাণের অন্তিম গন্তব্যও তারই নির্দেশ অনুযায়ী স্থির হয়।
আমি সত্যি বলছি, বন্ধুর ওইসব চিন্তাভাবনার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক ছিল না। আমি ভাবতে চেষ্টা করছিলাম, ও যা বলতে বা লিখতে চায়, তা নিশ্চয়ই আজগুবি। কেননা সেই অজানা জগতের অজানা লড়াইয়ের সাক্ষী হওয়ার মতো শক্তি আমার ছিল না।
এরপর এল সেই রাত। অজানা জগতের গভীর হাওয়ার ঢেউ আমাদের ভাসিয়ে নিয়ে চলেছিল অনন্ত শূন্যের ভেতরে। আমাদের অস্তিত্ব, আমাদের চেতনা থেকে ক্রমে দূরে, আরও দূরে আমরা হারিয়ে যাচ্ছিলাম। আমাদের মনের মধ্যে ভিড় করে আসছিল পাগলপারা আশ্চর্য সব অনুভূতি। অনন্তকে বুঝি অনুভব করতে পারছিলাম আমরা। অবিশ্বাস্য আনন্দে কাঁপছিলাম। সেইসব অনুভূতির খানিকটা আমার স্মৃতি থেকে মুছে গিয়েছে। যেটুকু মনে আছে, তাকেও ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।
ক্রমে সেই থকথকে প্রাচীরগুলির সংখ্যা বাড়ছিল। তারা আমাদের শরীরে যেন কামড় বসাচ্ছিল। যেতে যেতে একসময় আমি বুঝতে পারলাম, আমরা আজ এমন এক জগতে চলে এসেছি, যেখানে এর আগে কখনও আসিনি। এক পবিত্র ইথারের সমুদ্রের মধ্যে যেন আমরা ঝাঁপ দিয়েছি। আমার বন্ধু অন্য দিনের মতোই আমার থেকে অনেকটা এগিয়ে রয়েছে। তার মুখ আজ উজ্জ্বল ও অতি তরুণ। মনে হল, তার সেই ভেসে চলার মধ্যে কেমন একটা অশুভ ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে। আচমকাই তার সেই মুখ অস্পষ্ট হয়ে গেল। দেখতে দেখতে সে যেন মিলিয়ে গেল! আর তখনই চলতে চলতে আমি ধাক্কা খেলাম এমন এক প্রাচীরে, যাকে ভেদ করার ক্ষমতা আমার ছিল না। ঘন, আঠালো, দুর্ভেদ্য সেই প্রাচীরকে আমাদের চেনা জগতের কোনও কিছুর সঙ্গে তুলনা করা যায় না।
বুঝতে পারলাম, আমি এই প্রাচীরের সামনে আটকে গেলেও আমার বন্ধু সেই প্রাচীরকে অনায়াসেই পেরিয়ে গিয়েছে। প্রাচীরটা পেরিয়ে যাওয়ার জন্য আবার চেষ্টা করতেই আমার স্বপ্ন ভেঙে গেল। চোখ মেলে দেখলাম, আমি শুয়ে আছি টাওয়ার স্টুডিয়োর ভেতরে। ঘরের অন্যদিকে শুয়ে আছে আমার এতক্ষণের স্বপ্ন-সহযাত্রী। তখনও সে অচেতন। তার স্বপ্নালু মুখটা ম্লান। অথচ কী সুন্দর! জানলা দিয়ে আসা চাঁদের সোনালি আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে তার প্রত্ন-শরীর।
ক্ষণিকের নীরবতার পরে আচমকাই নড়ে উঠল তার শরীরটা। আর তারপরেই সে চিৎকার করে উঠল। ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না, কতটা তীক্ষ্ণ ছিল সেই চিৎকার! ঠিক যেমন বোঝাতে পারব না, কোন সুদূর নরকের ছায়া সেই সময় তার আতঙ্কিত চোখের তারায় ফুটে উঠেছিল! মাত্র এক মুহূর্তের ওই চিৎকার ও অমানুষিক দৃষ্টি সহ্য করতে না পেরে আমি জ্ঞান হারালাম। আমার বন্ধু চেতনা ফিরে পেয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে না-জাগানো পর্যন্ত অজ্ঞানই রইলাম।
স্বপ্নের ভেতরে আমাদের আশ্চর্য অভিযানের সেই শেষ। আমার বন্ধু পেরিয়ে গিয়েছিল সেই প্রাচীর, যা আমি টপকাতে পারিনি। সেখানে গিয়ে সে কী দেখেছে, তা বলার সাহস ওর ছিল না। কেবল ভীত, সন্ত্রস্ত ও হতবাক আমার বন্ধু আমাকে সতর্ক করে বলেছিল, চির-অচেনা অন্ধকারের রাজত্বে অভিযানের কথা আমাদের আর কক্ষনো ভাবা উচিত নয়।