করুণাময় ঈশ্বর কি সত্যিই আছেন? যদি থাকেন, তাহলে তাঁর কাছে আমার একান্ত প্রার্থনা, তিনি ওই কয়েক ঘণ্টার জন্য আমাকে রক্ষা করুন। যখন কোনও মনের জোর বা মানুষের তৈরি কোনও ড্রাগ আপনাকে ঘুমের অতলে তলিয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাতে পারে না, সেই সময়টা তাঁর করুণা আমার চাইই। মৃত্যু, আহা, তাকে এখন পরম মমতাময় বলে মনে হয়। আসলে যারা একবার রাত্রির গোপন কুঠুরিতে ঝাঁপ দিয়ে সেই অজানা সত্যির সন্ধান পেয়েছে, তারা জীবনে আর কখনও শান্তি পাবে না। আজকাল খালি মনে হয়, যেখানে প্রবেশের অনুমতি কারও নেই, কেন সেখানে বোকার মতো ঢুকতে গেলাম? ওই চিরন্তন রহস্যের সন্ধান কোনও মানুষের পক্ষে কখনও পাওয়া সম্ভব নয়। মনে পড়ে আমার বন্ধুর কথা। জানি না সে কে ছিল, কোনও নির্বোধ নাকি ঈশ্বরের দূত– যে-ই হোক, সে-ই ছিল আমাদের সফরের নেতা। আমাকে পেছনে ফেলে সামনে এগিয়ে গিয়ে সে মুখোমুখি হয়েছিল সেই ভয়ংকরতম দুঃস্বপ্নের, যা হয়তো আমারও হতে পারত।
মনে পড়ে তার সঙ্গে দেখা হওয়ার সেই প্রথম দিনটার কথা। একটা স্টেশনে তাকে আমি প্রথম দেখি। অজ্ঞান হয়ে সে পড়ে ছিল প্ল্যাটফর্মে। তার অচেতন শরীরটাকে ঘিরে ভিড় জমিয়েছিল কৌতূহলী জনতা। আচ্ছন্ন শরীরটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল খিঁচুনিতে। সেই সময়ই আমি তাকে প্রথম দেখি। চল্লিশের আশপাশে বয়স। মুখময় অজস্র রেখার কাটাকুটি। অসুস্থতার ছাপ স্পষ্ট। তবুও ডিম্বাকার মুখটা বড় সুন্দর। ঢেউখেলানো চুল আর দাড়ির মধ্যে রুপোলি রেখা। ভুরুটা ধবধবে সাদা, যেন শ্বেতপাথরে তৈরি। সব মিলিয়ে লম্বাচওড়া শরীরটা দেখলে মনে হয়, বুঝি কোনও শাপভ্রষ্ট দেবতা।
আমার ভেতরের যে শিল্পী, সেই ভাস্কর তার সমস্ত পাগলামি নিংড়ে বলে উঠল, আরে! এ যে পৃথিবীর কোনও আদিম দেবতার পাথুরে শরীর! কোনও প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে যাকে উদ্ধার করে কেউ তার শরীরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছে। যাতে দমচাপা এই নশ্বর জীবনের স্পন্দন সে অনুভব করতে পারে।
সে যখন তার উজ্জ্বল, ধ্যানমগ্ন, গভীর চোখ মেলে চেয়ে দেখল, সেই মুহূর্তেই আমি বুঝে গিয়েছিলাম, এই মানুষটি হতে চলেছে আমার বন্ধু। আমার মতো নির্বান্ধব এক মানুষের একমাত্র বন্ধু। তার দৃষ্টিতে ছিল আমাদের চেতনাময় বাস্তব জীবনের বহু দূরে অবস্থিত কোনও এক অচেনা ভয়াল দুনিয়ার সংকেত৷ যে জগৎকে আমি এতকাল কেবল কল্পনাই করতে চেয়েছি। বলা বাহুল্য, তাতেও ব্যর্থ হয়েছি।
আশপাশের ভিড় সরিয়ে তাকে আমি বললাম, চাইলে সে আমার বাড়ি যেতে পারে। দুর্বোধ্য রহস্যে ঘেরা অজানা জগতের সন্ধান পেতে তার মতো শিক্ষক আমার প্রয়োজন। সে কী বুঝল জানি না। তবে মাথা নেড়ে নীরবে আমার আহ্বানে সম্মতি দিল।
সেই সময়ে কোনও কথা না বললেও পরে আমি আবিষ্কার করেছিলাম, তার কণ্ঠস্বর আসলে এক সুর। চেতনার গভীর থেকে উঠে আসা এক আশ্চর্য সুর। আমি তার একটা প্রস্তরমূর্তি তৈরি করতে শুরু করে দিলাম। ছেনি-বাটালি দিয়ে কাজ করতে করতে আমরা কথা বলতাম। দিন হোক বা রাত আমাদের কথা চলত অনর্গল।
তার সঙ্গে কথা বলা অবশ্য কঠিনই ছিল, কেননা পার্থিব এই দুনিয়ার কোনও কিছুর সঙ্গেই তার কোনও সংস্রব ছিল না। তবু আমরা কথা বলতাম। আমাদের কথোপকথনের বিষয় ছিল এক অজানা, অসীম ব্রহ্মাণ্ড। চিরচেনা বস্তুজগৎ, সময় ও স্পেসের হিসেব সেখানে চলে না। সেই জগতের অবস্থান আমাদের সমস্ত অস্তিত্ব ও চেতনার অনেক গভীরে। কেবল ঘুমের ভেতরে স্বপ্নের অবয়বে সেই অচেনা ও ভয়ংকর জগতের আঁচ মেলা সম্ভব। সেই স্বপ্ন অবশ্যই আমাদের রোজকার দেখা স্বপ্ন নয়। স্বপ্নের ভেতরের সেই স্বপ্ন সাধারণ হরিপদ কেরানির জীবনে কখনও আসে না। কেবল কল্পনায় ঝুঁদ মানুষেরা সারাজীবনে হয়তো এক কি দু-বার সেই স্বপ্ন দেখতে পায়।
মানুষ তার জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে যে ব্রহ্মাণ্ডকে চিনেছে তা আসলে জন্ম নিয়েছে সেই অসীম জগতের ইশারায়। যেন এক আকস্মিকের খেলা। অনুসন্ধিৎসু মানুষরা কখনও হয়তো তার সামান্য আঁচ পায়। অবশ্য তারপরই সেটাকে অগ্রাহ্যও করে। জ্ঞানী মানুষেরা অবশ্য স্বপ্নকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাঁদের সেইসব প্রয়াসের আড়ালে সজোরে অট্টহাসি হেসে উঠেছেন ঈশ্বর।
এক আয়ত চোখের মানুষ একবার বলেছিলেন, সময় আর স্পেস আপেক্ষিক। শুনে সবাই ব্যঙ্গের হাসি হেসেছিল। সেই আয়ত চোখের মানুষটি অবশ্য কেবল আঁচটুকুই পেয়েছিলেন। আমি সবসময়ই চেয়েছি সেই সীমিত আন্দাজকে অতিক্রম করতে। বলাই বাহুল্য, পারিনি। আমার বন্ধু জানাল, সে-ও চেষ্টা করেছে। এবং খানিকটা সাফল্যও নাকি পেয়েছে। এবার আমরা দুজনেই চেষ্টা করা শুরু করলাম। হোরি কেন্টের পুরোনো ম্যানর হাউসের স্টুডিয়োর চেম্বারে উদ্ভট সব ড্রাগ সেবন করতে শুরু করলাম আমরা। যে ড্রাগসেবনে মগজে ভেসে আসে ভয়ানক ও নিষিদ্ধ স্বপ্নের সারি।
সেই দিনগুলোয় যে তীব্র যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে আমাদের যেতে হয়েছিল, তাকে ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। ওই কয়েক ঘণ্টার সফরে যা যা দেখেছি আর অনুভব করেছি, সেই ভয়ংকর ও অপার্থিব অভিজ্ঞতাকে প্রকাশ করার মতো চিহ্ন ও সংকেত পৃথিবীর কোনও ভাষার ভাণ্ডারেই খুঁজে পাওয়া যাবে না। ব্যাপারটা একটু খুলে বলা যাক। আমাদের সেই আশ্চর্য সফর জুড়ে ছিল অজানা এক উত্তেজনার দাপাদাপি। ঠিক কী কী দেখে আমরা ওরকম উত্তেজিত হয়েছিলাম, তা বলা সম্ভব নয়। কারণ তাকে নিজের স্নায়ু দিয়ে অনুভব করার সাধ্য কোনও সাধারণ মানুষের নেই। বস্তুজগৎ ও সময়ের অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় সব উপাদান মিলেমিশে ছিল সেই উত্তেজনার ভেতরে। উপাদানগুলি যেন একসঙ্গে গাঁথা। তাদের কোনও পৃথক অস্তিত্ব নেই।