কিন্তু তার আগেই ঘটল আর-এক অঘটন। রটারডামের এক সরাইখানায় আবিষ্কার করলাম, চুরি হয়ে গেছে আমার কবচ। চোরেরা গায়েব করে দিয়েছে আমার উদ্ধার পাওয়ার একমাত্র সম্বল। মুষড়ে পড়লাম আমি, ডুবে গেলাম অবসাদের অতলে। সে রাতে মনে হল, হাউন্ডের ডাক যেন আরও জোরালো হয়ে উঠেছে।
পরের দিন সকালে অপেক্ষা করছিল আর-এক খবর। এক অজানা দুর্বিপাক নেমে এসেছে শহরের এক নিকৃষ্ট পল্লিতে। আতঙ্কে সিঁটিয়ে রয়েছে সেখানকার লোকজন। অতীতের সমস্ত ভয়ংকর অপরাধকে নৃশংসতায় ছাপিয়ে গেছে সে ঘটনা। একটা জঘন্য বস্তিবাড়িতে হানা দিয়েছে রক্তলাল মৃত্যু। চোরছ্যাঁচড়ের সেই কদর্য আস্তানায় কোনও চিহ্ন না রেখেই এক অজানা আততায়ী ছিঁড়ে ফালাফালা করে রেখে গেছে একটা পুরো পরিবারকে। আর সারারাত আশপাশের মাতালের হুল্লোড় সত্ত্বেও নাকি হালকা শোনা গেছে। কোনও অতিকায় হাউন্ডের তেজি, চাপা ডাক।
ফের এসে দাঁড়াই সেই বিপজ্জনক গোরস্থানে। শীতকালের পাণ্ডুর চাঁদের আলো ভয়ানক সব ছায়া ফ্যালে। ফুটিফাটা সমাধি আর তুষার-পড়া বিবর্ণ ঘাসের ওপর বিরক্তি নিয়ে ঝুঁকে থাকে নিষ্পত্র, ন্যাড়া গাছগুলো। প্রতিকূল আকাশের দিকে আঙুল তুলে ব্যঙ্গ করে আইভি মোড়া গির্জা। হিমেল সাগর আর বরফ-জমা জলাভূমির ওপর দিয়ে ছুটে-আসা নিশীথ বাতাস হাহাকার করে চলে উন্মাদের মতন।
নিজের হাতেই কলুষিত করা সেই প্রাচীন কবরের কাছে এগোই পায়ে পায়ে। ভয় পেয়ে উড়ে পালায় কবরের ওপর উড়তে-থাকা বাদুড়ের বিশাল ঝাঁক। আগেই কমে এসেছিল হাউন্ডের ডাক, কবরের কাছে পৌঁছোতে এবার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় সে আওয়াজ।
কেন এলাম এই কবরের কাছে? এর নীচে শান্ত হয়ে শুয়ে আছে যে সাদা দেহাবশেষ, তার কাছে প্রার্থনা করতে? ক্ষমা চাইতে? নাকি পাগলের মতন কাকুতিমিনতি করতে? কারণ যা-ই হোক, তেড়েফুঁড়ে আক্রমণ করলাম কবরের হিম-জমাট মাটিকে। শুধু নিজেই যে হঠাৎ এমন বেপরোয়া হয়ে উঠলাম তা-ই নয়, মনে হল, আমার ওপর ভর করেছে বাইরের কোনও প্রবল ইচ্ছাশক্তি।
কবর খুঁড়ে ফেলতে বেগ পেতে হল না বিশেষ। মাঝে থেমেছিলাম একবারই। একটা শীর্ণ চেহারার শকুন হঠাৎ হিমেল আকাশ থেকে তিরবেগে নেমে এসে কবরের মাটি ঠোকরাতে আরম্ভ করেছিল পাগলের মতন। কোদালের এক ঘায়ে ভবলীলা সাঙ্গ করেছিলাম তার।
অবশেষে নাগাল পেলাম সেই জরাজীর্ণ লম্বাটে বাক্সটার। ওপর থেকে সরিয়ে ফেললাম তার সোরা-পড়া ঢাকনাটা। প্রকৃতিস্থ অবস্থায় এটাই আমার শেষ কাজ।
দেখলাম, সেই শতাব্দীপ্রাচীন কফিনে গাদাগাদি করে ঘুমিয়ে রয়েছে পেশিবহুল বিশাল বিশাল বাদুড়। আর সেইসব দুঃস্বপ্নের অনুচরদের আলিঙ্গনের মধ্যে ঘাপটি মেরে রয়েছে আমাদের চুরির শিকার সেই অস্থিসর্বস্ব দেহ। কিন্তু কোথায় আমাদের প্রথম দর্শনে দেখা সেই শান্ত, পরিচ্ছন্ন রূপ? এখন তার সর্বাঙ্গ ঢেকে রয়েছে শুকনো জমাট রক্ত, চুল আর মাংসের ফালিতে। ফসফরাসের মতন জ্বলন্ত দুই অক্ষিকোটর বাঁকা চাহনিতে তাকিয়ে রয়েছে আমার দিকেই। সে দৃষ্টিতে চৈতন্যের লক্ষণ স্পষ্ট। তার রক্ত-মাখা তীক্ষ্ণ শ্বদন্তগুলো মেলা বিকৃত ভঙ্গিতে, হয়তো-বা আমার আসন্ন সর্বনাশকে ব্যঙ্গ করেই।
সেই বাঁকা হাসিতে মেলা মুখের ফাঁক দিয়ে এবার বেরিয়ে এল একটা পরিহাস-মাখা চাপা আওয়াজ। ঠিক যেন কোনও অতিকায় হাউন্ডের ডাক। চমকে দেখলাম তার নোংরা রক্ত-মাখা নখে লটকে রয়েছে হারিয়ে-যাওয়া সবুজ জেড পাথরের কবচখানা। আমার গলা দিয়ে বেরিয়ে এল আতঙ্কের চিৎকার, ছুটে পালালাম বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে। খানিক বাদে খেয়াল করলাম, আমার চিৎকার পালটে গেছে উন্মাদের অট্টহাসিতে।
নক্ষত্র বায়ুতে সওয়ার হয় উন্মত্ততা… দাঁত-নখ তার শান-দেওয়া শত শত লাশে… ফোঁটায় ফোঁটায় মৃত্যু ছেটায় ভূগর্ভে পোঁতা শয়তান মন্দিরের নিকষকালো ধ্বংসাবশেষ থেকে উড়ে-আসা প্রমত্ত বাদুড়ের পালের পিঠে চড়ে।
ক্রমশ উচ্চগ্রামে চড়ছে সেই অস্থিসর্বস্ব ভয়ংকরের কুকুরের মতন ডাক। শিরা-উপশিরা মেলা অভিশপ্ত ডানা দুটোর সাঁইসাঁই পতপত শব্দ ক্রমাগত চক্কর মেরে এগিয়ে আসছে। কাছে। যার নাম নেই, যার নাম নিতে নেই, তার কাছ থেকে বাঁচার একমাত্র পন্থা আত্মবিলুপ্তি। আমার রিভলভার আমাকে সেই আত্মবিলুপ্তি এনে দেবে।
[প্রথম প্রকাশ: গল্পটি ১৯২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে উইয়ার্ড টেলস নামক পাল্প ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়। ভাষান্তর : সুমিত বর্ধন]
হিপনোস
হিপনোস (HYPNOS)
[লাভক্র্যাফটের সিংহভাগ লেখার মতোই এই গল্পেও রয়েছে অচেনা বিশ্বের অজানা ভয়ের কথা। ন্যাশনাল অ্যামেচার পত্রিকাতে প্রকাশিত এই গল্প তিনি উৎসর্গ করেছিলেন বন্ধু স্যামুয়েল লাভম্যানকে। লাভক্র্যাফটের দেখা দুটি স্বপ্নে লাভম্যান ছিলেন। যা থেকে তিনি দুটি গল্প (দ্য স্টেটমেন্ট অব র্যানডলফ কার্টার এবং নায়ারলাথোটেপ) লেখেন। পরে হিপনোস-এর মতো স্বপ্নতাড়িত গল্প লিখে তাই সেটি এই বন্ধুকেই উৎসর্গ করেন লেখক।]
এস এল-এর প্রতি
ঘুম সম্পর্কে বলা যায়, তাকে ঘিরেই আমাদের প্রতিরাতের দুঃসাহসিক অভিযান। আমরা বলতেই পারি, মানুষ রোজ বিছানায় যায়, এটা তার স্পর্ধা! আসলে পুরোটাই তার ধারণাতীত, বিপদ সম্পর্কে অবহেলারই ফল এটা।
— বোদলেয়র