এর দিন চারেক পরের কথা। আমরা দুজনেই তখন আমাদের গোপন মিউজিয়ামে। লাইব্রেরির যে লুকোনও দরজা থেকে সিঁড়ি নেমে এসেছে মিউজিয়াম অবধি, হঠাৎ মনে হল, সেই দরজা খুব ধীরে ধীরে সন্তর্পণে আঁচড়াচ্ছে কোনও কিছু। দু-দুটো ভয় চেপে ধরল আমাদের। এমনিতেই আমরা সর্বদাই আতঙ্কে থাকতাম, পাছে কেউ আমাদের এই বীভৎস সংগ্রহের কথা টের পেয়ে যায়। তার সঙ্গে এবার যোগ হল এই অজানা রহস্য।
সমস্ত আলো নিবিয়ে দিয়ে দরজার কাছে গিয়ে হঠাৎ করে খুলে দিলাম দরজা।
আমাদের ওপর এসে পড়ল একঝলক হাওয়া। আর তার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হল যেন ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে একটা খসখস শব্দ, খুকখুক হাসি, আর কারও ক্রমাগত বকবক করে যাওয়ার আওয়াজ। আমাদের মাথা খারাপ হয়ে গেছে, নাকি স্বপ্ন দেখছি, নাকি সজ্ঞানেই আছি, সেসব কিছু বোঝার চেষ্টা করিনি। কেবল আঁতকে উঠে উপলব্ধি করেছিলাম আর-একটা ব্যাপার। না-দেখা অশরীরী বকবক করে চলেছে হল্যান্ডের ভাষায়।
এর পরের দিনগুলো কাটতে লাগল একই সঙ্গে বিস্ময়ে আর আতঙ্কে। কখনও মনে হত, এককালের অপ্রাকৃতিক সব উত্তেজনার মাশুল চুকিয়ে হয়তো আমরা পাগল হয়ে যাচ্ছি। আবার কখনও কখনও নিজেদেরকে ধীরে ধীরে আসতে থাকা কোনও সর্বনাশা নিয়তির শিকার ভেবেও নাটুকে আনন্দে পেতাম। অদ্ভুত সব ব্যাপারস্যাপারও এবার থেকে নিত্যনৈমিত্তিক হয়ে দাঁড়াল। মনে হতে লাগল, আমাদের নির্জন বাড়িটা যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে কোনও অশুভ সত্তার উপস্থিতিতে। তবে তার গতিপ্রকৃতি যে কী, তা বোঝা ছিল আমাদের সাধ্যের বাইরে। প্রতিরাতেই দিগন্তবিস্তৃত মাঠের ওপর দিয়ে ভেসে আসতে লাগল দানবিক কুকুরের আওয়াজ। জোর থেকে আরও জোরে, ক্রমশই বাড়তে থাকল সে আওয়াজ। ২৯ অক্টোবরে নজরে পড়ল, লাইব্রেরির জানলার নীচের নরম মাটিতে পড়েছে কীসের যেন পায়ের ছাপ। অসাধ্য সে ছাপের বর্ণনা দেওয়া। এর সঙ্গে কে জানে কেন আমাদের পুরোনো বাড়িটাতে পালে পালে হাজির হতে শুরু করল বিশাল চেহারার সব বাদুড়। দিনে দিনে বাড়তে লাগল তাদের সংখ্যা।
চূড়ান্ত আঘাত নেমে এল ১৮ নভেম্বর। আমাদের বাড়ি থেকে স্টেশনটা বেশ দূরে। সেখান থেকে অন্ধকারে হেঁটে আসার সময়ে কোনও ভয়ংকর মাংসাশী পশুর কবলে পড়ল সেন্ট জন। সে আক্রমণে ফালাফালা হয়ে গেল সেন্ট জনের শরীর, তার মরণ চিৎকার ভেসে এল আমাদের বাড়ি অবধি। দৌড়ে গেলাম সেই ভয়ংকর ঘটনাস্থলের কাছে। লক্ষ করলাম, সদ্য-ওঠা চাঁদের প্রেক্ষাপটে মেঘের মতন ভাসছে অস্পষ্ট কালো কিছু একটা। তার সঙ্গে কানে এল পাখা ঝাপটানোর সাঁইসাঁই শব্দ। সেন্ট জনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলাম বটে, কিন্তু সে তখন পৌঁছে গেছে মৃত্যুর দোরগোড়ায়, স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারল না। ওই কবচটা ওই অশুভ জিনিসটা– এটুকু বলেই বেরিয়ে গেল তার প্রাণ, পড়ে রইল কেবল একটা ছেঁড়াখোঁড়া লাশ।
পরের দিন মাঝরাতে সেন্ট জনকে কবর দিলাম আমাদের অযত্নলালিত বাগানে। জীবদ্দশায় যেসব ভূতুড়ে গুহ্যবিদ্যা তার পছন্দ ছিল, পাঠ করলাম তারই কয়েকটা। শেষ ভৌতিক মন্ত্রটা আওড়াচ্ছি, অতিকায় হাউন্ডের অস্পষ্ট ডাক ভেসে এল জনশূন্য ফাঁকা মাঠের কোনও সুদূর কোণ থেকে। আকাশে ততক্ষণে চাঁদ উঠে গেছে, কিন্তু সেদিকে তাকাতে সাহস হল না। কেবল চোখে পড়ল, বিশাল প্রান্তরের স্বল্প আলোয় ঢিপি থেকে ঢিপিতে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে অস্পষ্ট একটা চওড়াটে ছায়ামূর্তি।
চোখ বন্ধ করে আছড়ে পড়লাম মাটিতে মুখ গুঁজে। কতক্ষণ বাদে জানি না, উঠে কোনওমতে টলতে টলতে উঠে পৌঁছোলাম বাড়ির ভেতরে। যত্ন করে রাখা সবুজ জেড পাথরের কবচের সামনে প্রণিপাত করতে শুরু করলাম অনবরত।
তেপান্তরের মাঠের মাঝখানে পুরোনো বাড়িতে একা থাকতে আর সাহস হচ্ছিল না। তাই কবচটা সঙ্গে নিয়ে পরের দিনই পাড়ি দিলাম লন্ডনের উদ্দেশে। যাওয়ার আগে নষ্ট করে দিয়ে গেলাম আমাদের মিউজিয়ামের অশুভ সংগ্রহ কিছুটা মাটিতে পুঁতে, কিছুটা পুড়িয়ে দিয়ে।
কিন্তু দিন তিনেক যেতে-না-যেতেই মনে হল, ফের শুনতে পাচ্ছি হাউন্ডের ডাক। হপ্তাখানেক বাদে অন্ধকার নামলেই মনে হতে লাগল, আমার দিকে কেউ তাকিয়ে রয়েছে। অদ্ভুত চোখে। একদিন সন্ধেবেলা হাওয়া খাচ্ছি ভিক্টোরিয়া বাঁধে, খেয়াল করলাম, নদীর জলে রাস্তার আলোগুলোর যে প্রতিফলন পড়েছে, তাদেরই একটা হঠাৎ ঢেকে দিল একটা কালো আকার। একই সঙ্গে রাতের বাতাসের চাইতে জোরালো একটা দমকা হাওয়া বয়ে গেল আমার পাশ দিয়ে। বুঝতে পারলাম, সেন্ট জনের ভাগ্যে যা ঘটেছিল, আমার কপালেও তা জুটতে বেশি দেরি নেই। কবচটাকে সাবধানে মুড়ে নিয়ে তাই পরের দিন চড়ে বসলাম হল্যান্ডগামী জাহাজে।
হাউন্ডটা এল কোথা থেকে? আমাকেই বা সেটা তাড়া করে বেড়াচ্ছে কেন? আমার কাছে এসব প্রশ্নের কোনও স্পষ্ট উত্তর ছিল না। কবচটা তার কবরে শুয়ে-থাকা নির্বাক মালিককে ফিরিয়ে দিলে কী হবে, তা-ও আমার জানা ছিল না। হাউন্ডের ডাক শুনেছিলাম প্রথমবার সেই প্রাচীন গোরস্থানে। শুরু সেখানে। তারপর সেন্ট জন তার শেষনিশ্বাসের সঙ্গে বলেছে কবচের কথা। আর এই দুইয়ের মাঝে ঘটেছে একের পর এক ঘটনা। সুতরাং ওই কবচ চুরির সঙ্গে আমার ওপর নেমে-আসা এই অভিশাপের যে একটা সম্পর্ক আছে, সেটা বুঝতে মোটেও অসুবিধে হচ্ছিল না। তাই মনে হয়েছিল, যুক্তি বিচার করে প্রতিটি পন্থা একবার পরখ করে দেখা দরকার।