পাণ্ডুর চাঁদের নজরদারিতে পোর লুটেরার কবরে ঝপাঝপ কোদাল পড়ে আমাদের। অদ্ভুতদর্শন গাছ, বুক-কাঁপানো ছায়া, প্রাচীন গির্জা, বিশাল বিশাল বাদুড়, জোনাকির নাচ, সব যেন প্রেক্ষাপটে ভাসে ছবির মতন। গুমরে-কাঁদা রাতের বাতাস রোমাঞ্চ ধরায় শরীরে। নানা উৎকট দুর্গন্ধে উলটে আসে নাড়ি। আর দূর থেকে ভেসে আসে কুকুরের অদ্ভুত ডাক। এত মৃদু সে আওয়াজ, যে নিজের কানকেই বিশ্বাস করা যায় না।
আচমকাই শ্যাওলার ভিজে স্তর পেরিয়ে কোদাল লাগে একটা শক্ত কিছুতে। একটা গোল লম্বাটে বাক্স। তার পচনে জীর্ণ আকারের গায়ে জমে রয়েছে আকরিকের কঠিন প্রলেপ। বাক্সটা তৈরি মোটা মজবুত জিনিসে বটে, কিন্তু এতই পুরোনো যে, সেটাকে চাড় মেরে খুলতে আমাদের বিশেষ বেগ পেতে হল না।
উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালাম বাক্সের অন্দরে। কী অদ্ভুত। পাঁচশো বছরের ব্যবধান সত্ত্বেও অবশিষ্ট রয়ে গেছে বাক্সের বাসিন্দার দেহাবশেষের অনেকটাই। অতীতের হত্যাকারীর চোয়ালের পেষণে কঙ্কালটার দু-একটা অংশ গুঁড়িয়ে গেছে বটে, কিন্তু তা সত্ত্বেও তার বেশির ভাগটাই অটুট। লম্বাটে দাঁত-বসানো খুলিটা ধবধবে সাদা, পরিষ্কার। অক্ষিকোটর দেখে বুঝতে অসুবিধে হয় না যে, এই চোখ এককালে আমাদের মতনই বিকারের নারকীয় আগুন জ্বলত ধকধক করে।
কফিনের একপাশে পড়ে একটা অদ্ভুত কবচ। হয়তো এককালে পরানো ছিল কফিনে শোয়া কঙ্কালের গলাতেই। অচেনা কায়দায় খোদাই-করা তার সবুজ জেড পাথরের গঠন। সূক্ষ্ম কারুকাজে প্রভাব প্রাচ্যের প্রাচীন শিল্পের। যেন গুঁড়ি মেরে থাকা একটা পাখা বসানো হাউন্ড। কিংবা একটা স্ফিংক্স, মুখ গড়া যার খানিকটা কুকুরের আদলে। সে মুখে একই সঙ্গে বিদ্বেষ, মৃত্যু আর পশুত্ব এমন ছাপ ফেলেছে যে, দেখলে আঁতকে উঠতে হয়। তার নীচের দিকটা ঘিরে খোদাই-করা কয়েকটা অক্ষর– দুর্বোধ্য সেই অজানা লিপির মর্ম। আর একদম তলায় সিলমোহরের কায়দায় খোদাই অদ্ভুতদর্শন একটা খুলির ভয়ংকর আকৃতি।
কবচটা চোখে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই দুর্নিবার হয়ে উঠল সেটাকে পাওয়ার আকর্ষণ। যেন ওই মান্ধাতার আমলের কবর থেকে নজরানা হিসেবে ওটাই প্রাপ্য আমাদের। কারণ খুঁটিয়ে দেখে বেশ বুঝতে পারছিলাম কবচটা আমাদের সম্পূর্ণ অপরিচিত নয়। কেবলমাত্র নির্মল সাহিত্য-শিল্পে দখল থাকলে হয়তো কবচের চেহারাটা অস্বাভাবিক ঠেকত। কিন্তু উন্মাদ আরব আবদুল আলহার্জেডের নিষিদ্ধ নেক্রোনমিকন বইখানা দেখা ছিল আমাদের। সে বইতে ইঙ্গিতে উল্লেখ ছিল এটারই কথা। মধ্য এশিয়ার এক দুর্গম প্রদেশের নাম লেং। সেখানকার শবভোজী সম্প্রদায়ের আত্মপ্রতীক এই বীভৎস কবচ। বুড়ো আরব প্রেতবিশারদ তাঁর বইতে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়ে গেছেন এ কবচের রূপের রেখাগুলোরও। মানুষের লাশ যারা দাঁতে ছিঁড়ে খায়, কোনও অজ্ঞাত অতিপ্রাকৃত পদ্ধতিতে তাদের আত্মার শক্তিতে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে ও রেখা।
হাতিয়ে নিলাম জেড পাথরের সবুজ কবচটা। কবচ মালিকের সাদা পরিষ্কার খুলি আর গুহার মতন অক্ষিকোটরের দিকে শেষবারের মতন দৃষ্টি দিয়ে কবরটা বুজিয়ে দিলাম আগের মতন।
হেমন্তের পাণ্ডুর চাঁদের ম্লান আলোয় ঠিক করে বোঝা গেল না, কিন্তু যখন তড়িঘড়ি জায়গাটা ছেড়ে চলে যাচ্ছি, মনে হল, আমাদের হাতে আলগা-হয়ে-যাওয়া কবরের মাটির ওপর নেমে এসেছে বাদুড়ের ঝাঁক। যেন সন্ধান করছে কোনও অশুভ, অভিশপ্ত পুষ্টির।
পরের দিন যখন জাহাজে চড়ে দেশের উদ্দেশে রওনা দিলাম, মনে হল যেন দূর থেকে ভেসে আসছে কোনও অতিকায় হাউন্ডের মৃদু ডাক। কিন্তু সে সময়ে হেমন্তের দুঃখী বাতাস কেঁদে চলেছে নিস্তেজ আওয়াজে। তাই এবারেও ঠিক করে কিছু বোঝা গেল না।
ইংল্যান্ডে ফেরার এক সপ্তাহের মধ্যেই শুরু হল যত অদ্ভুত ঘটনা। জনশূন্য পাণ্ডববর্জিত বিশাল মাঠের মাঝখানে একটা প্রাচীন জমিদারবাড়ির কয়েকখানা ঘরে ছিল আমাদের নিঃসঙ্গ বাস। বন্ধুবান্ধব দূরস্থান, চাকরবাকর পর্যন্ত ছিল না। অতিথির আগমনে কদাচিৎ বেজে উঠত আমাদের দরজার কড়া। কিন্তু এবার মনে হতে লাগল, রাতবিরেতে বাড়ির দরজা আর দুটো তলারই জানলা হাতড়াচ্ছে কেউ। কখনও-বা মনে, হল লাইব্রেরির জানলায় চাঁদের আলো ঢেকে দিয়েছে কোনও বিশাল ছায়ামূর্তি। আবার কখনও মনে হল, কাছেই কোথাও সাঁইসাঁই শব্দে পাখা ঝাপটাচ্ছে কিছু৷ কিন্তু প্রত্যেকবারই খোঁজাখুঁজির পর নজরে পড়ল না কিছুই। অতএব দায় চাপালাম কল্পনার ওপর। হল্যান্ডের গোরস্থানে শোনা কুকুরের ডাক যেমন মনে হত, শুনতে পাচ্ছি তখনও, মনে হল, এসবও হয়তো সেইরকমই কোনও অলীক কল্পনা।
জেড পাথরের কবচটার ঠাঁই হল আমাদের মিউজিয়ামের এক কোণে। মাঝেমধ্যে তার সামনে নানা বিচিত্র গন্ধের মোমবাতি জ্বালি আমরা। চলে আলহার্জেডের নেক্রোনমিকন থেকে কবচের বিষয়ে পড়াশোনাও। ক্রমে বুঝতে পারি গোর লুটেরাদের প্রতীক আর তাদের আত্মাদের মধ্যের সম্পর্কের রহস্য। যা পড়ি, তাতে আরও দুশ্চিন্তা জমে উঠতে থাকে মনে।
তারপর একদিন হানা দিল আতঙ্ক।
সে দিন ২৪ সেপ্টেম্বর। রাতের বেলায় খটখট করে উঠল আমার ঘরের দরজা। ভাবলাম হয়তো সেন্ট জন। কিন্তু তাকে যখন ভেতরে আসতে বললাম, তখন কে যেন হেসে উঠল খনখনে আওয়াজে। করিডরে বেরিয়ে কাউকে দেখতে পেলাম না। ঘুম থেকে টেনে তুললাম সেন্ট জনকে। কিন্তু সে বলল, সে কিছু জানে না। দুশ্চিন্তা গ্রাস করল দু জনকেই। এই রাতেই প্রথম মনে হতে লাগল, ধু ধু মাঠের ওপর দিয়ে দূর থেকে ভেসে আসা কুকুরের অস্পষ্ট ডাক হয়তো এক ভয়ানক সত্য।