সেই বীভৎস নিন্দনীয় কাজের নাম কবর লুণ্ঠন।
আমাদের ভয়ানক সব অভিযানের বিবরণ দেব না। লুট করে আনা মালপত্রের ফিরিস্তিও দেব না। তবে এটুকু জানিয়ে রাখি যে, সেসব সংগ্রহের ঠাঁই হয়েছিল আমাদের বাড়ির মিউজিয়ামে।
আমাদের সুবিশাল পাথরের বাড়িটাতে বাসিন্দা বলতে ছিলাম কেবল আমি আর সেন্ট জন। সঙ্গ দেবার জন্যে দাসদাসী পর্যন্ত ছিল না। এই বাড়িরই বহু নীচে, ভূগর্ভের অন্দরে এক গোপন কামরায় গড়ে তুলেছিলাম আমাদের মিউজিয়াম।
আমাদের আসক্তিক্লান্ত ইন্দ্রিয়গুলোকে ফের চাঙ্গা করে তুলতে চেয়েছিলাম আমরা। মেতেছিলাম তাই উন্মাদ শিল্পীদের নারকীয় রুচিতে। সেই ভয়ানক সংগ্রহশালায় গড়ে তুলেছিলাম আতঙ্ক আর বিনাশের এক অকল্পনীয় দুনিয়া। ঘরের দেওয়াল জুড়ে বসানো ছিল কালো ব্যাসাল্ট আর অনিক্স পাথরে কোঁদা বিশাল বিশাল দানবমূর্তি। দু-পাশে পাখা মেলে তারা তাদের মুখের অট্টহাসির ফাঁক দিয়ে উগরে দিত উদ্ভট সবুজ আর কমলা রঙের আলো। গোপন পাইপ দিয়ে বয়ে-আনা হাওয়ায় ফুলেফেঁপে উঠত বিশাল বিশাল কালো পর্দা। তাদের গায়ে লাল রঙে আঁকা হাতে হাত ধরা অস্থিমূর্তিরা যেন মেতে উঠত এক মরণ নৃত্যে। পাইপ দিয়ে কেবল হাওয়া নয়, বয়ে আসত আমাদের মেজাজ শরিফ করার জন্যে নানান গন্ধ। কখনও অন্তিম সত্ত্বারের লিলি ফুলের হালকা সুবাস। কখনও-বা প্রাচ্যের অধিপতিদের সমাধিগৃহের ধূপের মাদক সুগন্ধ। আবার কখনও মাটি-তোলা কবরের অন্তরাত্মা-কাঁপানো উৎকট দুর্গন্ধ।
এই ভয়ংকর কামরার দেওয়ালের গায়ে পরপর রাখা ছিল প্রাচীন মমির সারি। তাদের পাশে পাশে দাঁড়িয়ে থাকত সংরক্ষিত মৃতদেহ। ট্যাক্সিডার্মিস্টের হাতের কারিকুরিতে প্রাণবন্ত দেখাত সেসব ন্যাকড়া-ঠাসা লাশ। তাদের মাঝে ইতস্তত রাখা ছিল পৃথিবীর নানা প্রাচীন গোরস্থান থেকে লুটে-আনা সমাধিশীর্ষের ফলক। ঘরের নানান কোণে সাজানো থাকত নরমুণ্ড। তাদের এক-একটাতে পচনের ছাপ এক-একরকম। কোথাও অভিজাতবংশীয়দের কেশহীন গলিত মস্তক। আবার কোথাও সদ্য কবর-দেওয়া শিশুদের ঝকঝকে সোনালি চুলে সাজানো তাজা মুণ্ড। ভয়ানক বিষয়বস্তুর ওপর ছবি আর স্থাপত্যেরও কমতি ছিল না। তাদের বেশ কিছুই সৃষ্টি আমার আর সেন্ট জনের। ছিল মানুষের চামড়ায় বাঁধাই একটা তালা-মারা কাগজপত্রের ব্যাগ। তার অন্দরে রাখা ছিল এমন সব অকল্পনীয় ছবি, যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। সেসবই কুকীর্তি নাকি স্বয়ং শিল্পী গয়ার, যদিও ভয়ে তিনি কখনও সে কথা স্বীকার করেননি। অভাব ছিল না বিকট সব তারের আর ফু-দেওয়া বাদ্যযন্ত্রেরও। আমার আর সেন্ট জনের হাতে পড়ে সেইসব কাঠ আর পেতলের বাজনা বেজে উঠত বীভৎস আওয়াজে কখনও স্বরবিচ্যুতির অসহনীয়, আবার কখনও দানবিক চিৎকারের ভয়ানক অট্টরোলে। এ ছাড়া ছিল নকশিকাটা কালো আবলুশ কাঠের বহু আলমারি। সেসব ঠাসা কবর থেকে লুট করে আনা নানান অবর্ণনীয় সামগ্রীতে। প্রত্যেকটা আমাদের উন্মাদনা আর বিকৃতির ফসল। নিজের প্রাণ নিতে যাওয়ার আগেই এগুলো সব নষ্ট করে দিয়েছি, সুতরাং আর বিশদে কিছু বলতে চাই না।
মুখে নাম আনা যায় না, এমন সব জিনিসপত্রের সন্ধানে আমরা কবরে হানা দিতাম শিকারির মতনই। কিন্ত তা বলে ছোটলোক গোর লুটেরাদের মতন হামলে পড়িনি। আমাদের কাছে এই শখ ছিল সূক্ষ্ম শিল্পের নামান্তরমাত্র। তাই যেন শিল্পসাধনা হয়ে উঠত প্রতিটি অভিযান। নিজেদের মেজাজ, প্রাকৃতিক শোভা, পরিবেশ, আবহাওয়া, ঋতু, চাঁদের আলো ইত্যাদি নানান কিছু মনোমতো হলে, তবেই নামতাম কাজে। কবরের গহ্বর ভয়ানক হাসিতে তার অভ্যন্তরের রহস্য মেলে ধরলে যে চরম আনন্দের অনুভূতি হয়, তার অন্তরায় অনেক। সময়জ্ঞানের অভাব, আচমকা ঝলসে-ওঠা বিদ্যুৎ, কিংবা আনাড়ি হাতে মাটি উলটে ফেলা, এ ধরনের সামান্য উলটো-পালটা হলেই ছিল সব পরিশ্রম পণ্ড হবার সম্ভাবনা। খুঁটিনাটির ওপর তাই তীক্ষ্ণ নজর থাকত আমাদের।
নিত্যনতুন দৃশ্যপটে আরও চড়া দাগের অভিজ্ঞতা ভোগ করার বাসনা চেপে বসেছিল আমাদের ওপর। যেন এক চির-অতৃপ্ত বিকার। আর এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা ছিল সেন্ট জনের। সেই পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিল সেই অভিশপ্ত গোরস্থানে। সেখানেই আমাদের ওপর নেমে এসেছিল ভয়ংকর এক অমোঘ নিয়তি।
একটা অসুস্থ প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে পা রেখেছিলাম আমরা হল্যান্ডের সেই সাংঘাতিক কবরখানায়। কয়েকটা ভয়ানক গুজব আর কিংবদন্তি যেন টেনে নিয়ে গিয়েছিল আমাদের। কানে এসেছিল, গোরস্থানের এক কবরে পাঁচশো বছর ধরে শুয়ে আছেন এমন একজন, যিনি জীবদ্দশায় নিজেই ছিলেন গোর লুটেরা। কোনও এক চোখধাঁধানো সমাধিগৃহ থেকে নাকি চুরি করে এনেছিলেন এমন কিছু, যার ক্ষমতা মারাত্মক।
সে দিনের সেই মুহূর্তের কথা আজও মনে আছে। মাথার ওপর হেমন্তের চাঁদ। তার ম্লান। আলোয় ভয়-ধরানো ছায়া ফেলেছে কবরগুলো। সমাধির জরাজীর্ণ বেদি আর অযত্নে বেড়ে ওঠা ঘাসের ওপর একরাশ বিরক্তি নিয়ে ঝুঁকে রয়েছে কদাকার গাছগুলো। আকাশে চাঁদের প্রেক্ষাপটে পাক খাচ্ছে অগুনতি বিশালদেহী বাদুড়ের ঝাঁক। আইভি লতায় ঢাকা প্রাচীন গির্জাটা ভূতুড়ে আঙুল উঁচিয়ে রয়েছে আকাশের দিকে। দূরে ঝোপঝাড়ের আনাচকানাচে আলেয়ার নাচ নেচে চলেছে জোনাকির দল। দূরের সাগর আর জলাভূমির ওপর দিয়ে আসা বাতাসে মিশেছে গাছগাছড়া, ছত্রাক আর নানান অজানা জিনিসের গন্ধ। আর এসবের সঙ্গে ভয়ের আর-এক মাত্রা যোগ করেছে অজানা উৎস থেকে ভেসে-আসা কুকুরের ডাক। যেন দূরে কোথাও একনাগাড়ে ডেকে চলেছে কোনও অতিকায় হাউন্ড। সে আওয়াজ শিহরন ধরিয়ে দেয় শরীরে, মনে করিয়ে দেয় চাষাভুসোর মুখে শোনা গল্পটা। যার কবরের তল্লাশে এখানে আসা, তার লাশ পাওয়া গিয়েছিল এখানেই। ছেঁড়া, থ্যাঁতলানো সেই শরীর যেন খুবলে ফেলেছিল কোনও অবর্ণনীয় পশুর দাঁত-নখ।