মানবসভ্যতার ইতিহাস সম্পর্কে আমি যা যা পড়লাম, এখনকার যে-কোনও তথাকথিত পণ্ডিতের মাথা ঘুরিয়ে দেবার পক্ষে যথেষ্ট। বেশির ভাগই হায়ারোগ্লিফিকে লেখা থাকলেও আমি সেগুলো বুঝতে পেরেছিলাম ড্রোনিং মেশিনের সাহায্যে। তবে অন্যান্য বেশ কিছু খণ্ড এমন বিটকেল ভাষায় লেখা ছিল, হাজার চেষ্টা করেও প্রথমে সেগুলো উদ্ধার করতে পারিনি। পরে এগুলো পড়তেও কাজে লাগাই ড্রোনিং মেশিন। তবে জেগে ওঠার পর খুব ঝাপসাভাবে এই স্মৃতিগুলো আমার মনে থাকত। এই উন্নত জাতি কীভাবে সময়কে জয় করেছে, সেটা ভেবে খুব অবাক লাগত। তার থেকেও বেশি অবাক হতাম এটা ভেবে, বর্তমান সময় থেকে আমার চেতনাকে সরিয়ে আনার পাশাপাশি ঠিক একই সময়ে কেউ ব্যবহার করে চলেছে আমার শরীর। শুধু তা-ই নয়, বৃহস্পতি, শুক্রর মতো গ্রহ থেকেও ইথরা চেতনা সংগ্রহ করেছিল। আমাদের এই পৃথিবীর চেতনাশক্তির মধ্যে ছিল অ্যান্টার্কটিকার ডানাওয়ালা তারার মতো মুওয়ালা আধা উদ্ভিদ প্যালিওজিয়ন প্রজাতি, ভ্যালুসিয়ার সরীসৃপ প্রজাতি, এমনকী প্রাক-মানবসভ্যতার সাতগুয়ার রোমশ জাতির গোটা চারেক নমুনা, বিবর্তনের শেষ পর্যায়ের মাকড়সা প্রজাতি আর ভয়ানক চো চো প্রজাতির নমুনাও ছিল।
এই সময় পাঁচ হাজার খ্রিস্টাব্দের এক দার্শনিক ইয়াং লি-র চেতনার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। দেখা হয়েছিল লেমুরের সম্রাটের সঙ্গেও, যিনি লক্ষ বছর আগে মেরুদেশে সাম্রাজ্য করতেন, হলুদ চামড়ার ইয়টদের আক্রমণের আগে। কথা বলেছিলাম ষোলো হাজার খ্রিস্টাব্দের এক জাদুকর নাগসোথের সঙ্গেও। এবং এদের সঙ্গে কথা বলে আমি অতীতের বহু সমাধান না-হওয়া রহস্যের আর ভবিষ্যতের বহু আসন্ন বিপর্যয় ও ঘটনার কথা জানতে পেরেছিলাম।
এইসব স্বপ্নচারণের পর প্রত্যেকদিন সকালে আমার যখন ঘুম ভাঙত, দেখতাম, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্বপ্ন থেকে পাওয়া ইতিহাস ও বিজ্ঞান নিয়ে এইসব নানারকম তথ্য নিয়ে আমি গবেষণা শুরু করে দিতাম এবং আরও অনেক নতুন নতুন তথ্য পেতাম। এখনকার বহু বিষয়, মানে যেগুলো নিয়ে অনেকের সন্দেহ আছে, স্বপ্নের মাধ্যমে তা অনায়াসে সমাধান করে দিতাম। টের পেতাম, অতীতের এমন অনেক সত্য গোপন ছিল, যা প্রকাশ পেলে সমগ্র মানবজাতি এক ভয়ানক বিপর্যয়ের মুখোমুখি হবে। মানবসভ্যতার পরে পৃথিবীর বুকে সৃষ্টি হবে কীট-সভ্যতার, যারা শাসন করবে গোটা দুনিয়া। এবং অবশ্যই ইথরা শাসন করবে গোটা ব্রহ্মাণ্ডকে। চেতনা আদানপ্রদানের খেলা অবশ্য চলতেই থাকবে। ইথিয়ান লাইব্রেরির যাবতীয় তথ্য নথিভুক্ত করা হত শক্ত সেলুলোজজাতীয় কাপড়ে। হাতে লেখা আর ছাপানো দু-রকমই থাকত বই আকারে বাঁধাই অবস্থায়। বলা বাহুল্য, এই স্বপ্নগুলো কখনওই আমাকে দৈনন্দিন জীবনের ছবি দেখায়নি। ইথিয়ান দুনিয়ায় আমি এতরকম প্রাণী আর প্রজাতি দেখেছিলাম, যে সবার কথা বলতে গেলে খণ্ডের পর খণ্ড লেখা হয়ে যাবে। খুব সম্ভবত আমি স্বপ্নে যে যুগের কার্যাবলি দেখতাম তা ছিল ১৫ কোটি বছরেরও আগেকার সময়ের– যখন পেলোজোয়িক যুগ শেষ হয়ে মেসোজোয়িক যুগ শুরু হতে যাচ্ছে।
এই সময় ইথরা প্রায় মানুষের মতোই দেখতে এক ধরনের প্রাণীর শরীর দখল করেছিল। এই প্রাণীগুলো ঠিক কী পর্যায়ের বলতে পারব না, কারণ প্রচলিত বৈজ্ঞানিক ধারণার ভিত্তিতে এদের সম্পর্কে বলা সম্ভব নয়। ইথদের কোষের গঠন ছিল অদ্ভুত আর অভিনব। এবং এই কোষের গঠনের জন্যই তারা কখনও ক্লান্ত হত না। তাই ঘুমেরও দরকার হত । যাবতীয় পৌষ্টিক কার্যাবলি চালাত ওই শুড়ের মতো উপাঙ্গ দিয়েই। আমাদের পরিচিত অনুভূতির মধ্যে মাত্র দুটি এদের মধ্যে বিদ্যমান ছিল– দেখা আর শোনা। শোনার কাজ চালাত মাথার ওপরে থাকা ফুলের মতো ধূসর রঙের অংশ দিয়ে আর দেখার কাজ চালাত কুতকুতে তিনখানা চোখ দিয়ে। এদের রক্ত ছিল থকথকে সবুজ রঙের। ইথদের মধ্যে কোনওরকম যৌনক্রিয়া না থাকলেও প্রজননের কাজ তারা চালাত বীজ বা দেহের নীচের দিকে থাকা এককোষী যৌন জননাঙ্গ দিয়ে। অগভীর জলাশয়ে চলত সদ্যোজাতদের বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়া। ইথরা ছিল যথেষ্ট দীর্ঘায়ু। কম করে চার থেকে পাঁচ হাজার বছর ছিল এদের আয়ু। যেহেতু ইথদের স্পর্শক্ষমতা বা যন্ত্রণাবোধ ছিল না, তাই সদ্যোজাতদের মধ্যে কারও কোনও খুঁত থাকলে তা ইথরা চোখে দেখলেই বুঝে যেত আর সঙ্গে সঙ্গে তাকে মেরে ফেলা হত। মৃত্যুর পর মৃতদের শরীর পুড়িয়ে ফেলা হত। ইথদের হাতে বন্দি হওয়া কেউ কেউ ভবিষ্যৎ দেখতে পাওয়ার ফলেই কখনও কখনও আসন্ন মৃত্যুকে এড়াবার জন্য পালাতে সক্ষম হলেও এই ধরনের ঘটনা প্রায় ঘটত না বললেই চলে। ইথরা মিলিত হয়ে যে সমাজ গড়ে তুলেছিল, তাতে একনায়কতন্ত্রের প্রভাব লক্ষণীয় ছিল। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তিকে যে উচ্চতায় তারা নিয়ে গিয়েছিল তা ধারণার বাইরে।
স্বপ্নচারণ আর জেগে উঠে যেটুকু মাথায় থাকত, সেগুলো নিয়ে সাত-পাঁচ ভাবা এইভাবেই চলছিল। আমার দুঃস্বপ্নের শেষ হত আমার চিৎকার দিয়ে। এগুলো আমার রোজনামচা হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মাঝে একই রকম বিভিন্ন কেস নিয়ে অনুসন্ধান চালাতাম। ১৯২২ সালে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলেও ওই অপার্থিব আতঙ্ককে অতিক্রম করা ছিল আমার সাধ্যের বাইরে। হয়তো এইভাবেই চলত, তারপর একদিন সমস্ত হিসেব গেল গুলিয়ে।