যা-ই হোক, দূর ভবিষ্যতের ফলাহার-পর্বের কথাই বলি আপনাদের। খিদের জ্বালা একটু কমতেই ঠিক করলাম, এদের ভাষা আমাকে শিখতে হবে। একটা ফল উঁচু করে ইশারায় নাম জিজ্ঞেস করলাম। ওরা তো প্রথমে হেসেই কুটি কুটি। শেষে, বেশ সুন্দর চুলওয়ালা একজন বোধহয় কিছু বুঝল। এগিয়ে এসে একটা দুর্বোধ্য শব্দ উচ্চারণ করল সে। অনেক চেষ্টায় রপ্ত করলাম পুঁচকে শব্দটা। এইভাবে একটা একটা করে অন্তত বিশটা দ্রব্যবাচক বিশেষ্য শিখে নিলাম। তারপর সর্বনাম আর খাওয়া, এই ক্রিয়াপদটাও শেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ওই একঘেয়ে প্রশ্নোত্তরে ওরা বেশ ক্লান্ত আর অনিচ্ছুক হয়ে পড়েছে দেখে ঠিক করলাম, রয়ে-সয়ে শিখে নেওয়া যাবে ওদের ইচ্ছেমতো। পরে অবশ্য বুঝেছিলাম যে, এদের মতো শ্রমবিমুখ আর এত অল্পে পরিশ্রান্ত মানুষ আমি আর জীবনে দেখিনি।
০৬. অস্তগামী মানবজাতি
৬। অস্তগামী মানবজাতি
অল্পক্ষণের মধ্যেই খুদে মানুষদের মধ্যেই একটা জিনিসের বিশেষ অভাব দেখলাম, তা হল আগ্রহ। ছেলেমানুষের মতো হুল্লোড় করে অবাক হয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে ওরা আমাকে ঘিরে ধরত, কিন্তু ক্ষণ পরেই আমাকে ছেড়ে ছুটত নতুন কোনও খেলার সন্ধানে। ডিনার খাওয়ার সময়ে যারা আমাকে ঘিরে বসেছিল, খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই দেখলাম তাদের অনেকেই আর নেই। এরপরেও যখনই বাইরে বেরতাম, কতশত পুঁচকে মানুষ ছুটে এসে ঘিরে ধরত আমাকে, কিন্তু আগ্রহ ফুরাতে বেশিক্ষণ লাগত না। যেন তাদেরই একজন আমি, এমনিভাবে কিছুক্ষণ হাসাহাসি হুটোপাটি করে চলে যেত অন্যদিকে।
বিরাট হলঘর ছেড়ে যখন বাইরে বেরলাম, সূর্য তখন ডুবুডুবু। লাল আভায় রাঙিয়ে উঠেছে চারদিক। ছেড়ে-আসা বিরাট বাড়িটা দেখলাম মস্ত চওড়া একটা নদীর উপত্যকার ওপর। আমাদের টেমস নদী বর্তমান স্থান ছেড়ে মাইলখানেক দূরে সরে গেছে। ঠিক। করলাম, মাইল দেড়েক দূরের পাহাড়টার চুড়োয় উঠে আট লক্ষ দুহাজার সাতশো এক সালের পৃথিবীকে আশ মিটিয়ে দেখতে হবে। সালটা অবশ্য আমার মেশিনের ছোট ডায়াল থেকে পেয়েছিলাম। পাহাড়ের ওপর একটু উঠতেই দেখলাম গ্রানাইটের বিরাট একটা স্তূপ। রাশি রাশি অ্যালুমিনিয়াম দিয়ে পরস্পর জোড়া পাথরের তৈরি ভাঙাচোরা উঁচু উঁচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা বিপুল একটা গোলকধাঁধা। এখানে-সেখানে রাশি রাশি প্যাগোডার মতো ছড়ানো ভারী সুন্দর গাছ, বোধহয় বিছুটি হবে। পাতাগুলোয় কিন্তু আশ্চর্য সুন্দর বাদামি ছোপ, তা ছাড়া বিছুটির সে তীব্র জ্বলুনিও নেই তাতে৷ দেখেই বুঝলাম বিরাট কোনও স্থাপত্যের ধ্বংসস্তূপ সেটা। এরকম ধ্বংসস্তূপ এখানে-সেখানে অনেক দেখলাম। কিন্তু এই বিশেষ স্তূপটাতেই আমি এক অতি বিচিত্র অভিজ্ঞতার, বিচিত্রতর আবিষ্কারের সম্মুখীন হয়েছিলাম কিন্তু সে কথা পরে আসছে।
উঁচু থেকে আরও একটা জিনিস লক্ষ করলাম। ছোট আকারের বাড়ি দেখতে পেলাম না কোথাও। স্বতন্ত্র গৃহস্থালিও উবে গেছে একেবারে। সবুজ প্রকৃতির মাঝে এখানে-সেখানে শুধু বিপুল আকারের মর্মর-প্রাসাদ। ইংলিশ কটেজের চিহ্ন নেই কোথাও।
কমিউনিজম, আপন মনেই বলি আমি।
আমার পেছনে তখনও জনা ছয়েক পুঁচকে মানুষ আসছিল। তাদের পানে চোখ পড়তে আচমকা আর-একটা বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলাম। ওদের প্রত্যেকেরই একই পোশাক, একই রকম কেশহীন নরম মুখ আর মেয়েদের মতো সুডৌল অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। এতক্ষণ এই আশ্চর্য বৈশিষ্ট্যটুকু চোখেই পড়েনি আমার। কিন্তু একটু ভাবতেই বুঝলাম আসল কারণটা। এ যুগের মানুষদের নারী-পুরুষের আকৃতি একই। শুধু পোশাকের বুনন আর অন্যান্য কয়েকটি তফাত দেখে বুঝে নিতে হয় নারী-পুরুষের প্রভেদ। খুদে মানুষদের ছেলেমেয়েরা কিন্তু বাপ-মায়েদের ছোট সংস্করণ। একটা জিনিস দেখেছি, এরপরেও ও যুগের খোকাখুকুরা শুধু দেহে নয়, মনের দিক দিয়েও অনেক অকালপক্ক।
নারী-পুরুষের এই অভিন্নতা দেখে খুব বেশি অবাক হলাম না। বরং ভাবলাম, এই তো স্বাভাবিক। যে যুগে দৈহিক বলের প্রাধান্য বেশি, সেই যুগেই তো পুরুষের শক্তি, নারীর ল্যবণ্য আর রকমারি পেশার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কিন্তু যে যুগে নিটোল নিরাপত্তা মানুষের জীবন ছেয়ে আছে সেখানে, এ ভেদাভেদ লোপ পাওয়াটাই তো স্বাভাবিক।
পাহাড়ের ওপরের দিকে কিন্তু বড় বাড়ি আর একটাও দেখতে পেলাম না। তবে অত উন্নত যুগেও গুমটিঘরের মতো ছাউনির নিচে একটা কুয়ো দেখে একটু অবাক হলাম। যা ই হোক, আমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে খুদে মানুষরা অনেক আগেই আমার সঙ্গ ত্যাগ করেছিল। এখন পাহাড়ের চুড়োয় এসে পৌঁছালাম আমি। নাম-না-জানা একরকম হলদে ধাতুর তৈরি একটা আসন দেখলাম সেখানে, লালচে রঙের মরচে আর নরম শেওলায় ছেয়ে গিয়েছিল ওপরটা। হাত দুটো গ্রিফিনের ছাঁচে ঢালাই করা। এই আসনে বসে সূর্যের পড়ন্ত আলোয় দেখলাম প্রাচীন পৃথিবীর বিচিত্র রূপ। সূর্য তখন দিক্রেখার নিচে নেমে গেছে, সিঁদুরে আভার সঙ্গে সোনালি ঝিকিমিকিতে রঙিন হয়ে উঠেছে পশ্চিমের আকাশ। বহু নিচে পালিশ-করা ইস্পাতের তরোয়ালের মতো রয়েছে টেমস নদী। সবুজ ভূমির মাঝে এখানে-সেখানে ছড়িয়ে রয়েছে বিপুলাকার প্রাসাদ আর প্রাসাদকিছু কিছু ভেঙেচুরে গিয়ে মাটি আশ্রয় করেছে। ধরণির অবারণ বাড়ন্তে ভরা বাগিচার মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে সাদা বা রুপোলি মূর্তি, কোথাও বা গম্বুজ আর চার কোণে থামের ছুঁচোলো শীর্ষবিন্দু৷ বেড়া দিয়ে ঘেরা কোনও স্থান নেই, মালিকানাস্বত্বের কোনও চিহ্ন নেই, কৃষিকাজের কোনও প্রমাণ নেই। সমস্ত ধরণি জুড়ে শুধু একটি বাগান, আর কিছুই নেই।