চোখ ফিরিয়ে আবার তাকালাম গুঁড়ি মেরে বসা সাদা মূর্তিটার দিকে। হঠাৎ আমার এই অভিযানের গোঁয়ারতুমি সমস্ত অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করলাম। অস্পষ্ট ওই পরদা একেবারেই মিলিয়ে যাওয়ার পর না জানি কী দৃশ্য দেখব আমি। মানুষ আজ কী অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে? নিষ্ঠুরতাই কি তাদের সহজ প্রকৃতি? এই সুদীর্ঘকাল পরে মানুষ যে তার মনুষ্যত্ব হারিয়ে একটা অমানবিক নির্মম আর কল্পনাতীত শক্তিমান প্রাণীর পর্যায়ে নেমে যায়নি, তা কে বলতে পারে? হয়তো তাদের চোখে আমি আদিম বিদঘুটে আকারের ভয়ানকদর্শন বর্বর জানোয়ার ছাড়া আর কিছু না, যাকে দেখামাত্র নিধন করতে তৎপর হয়ে উঠবে তারা।
ইতিমধ্যে আরও কয়েকটা বিপুল আকার দেখতে পেলাম। কমে-আসা ঝড়ের বুক চিরে অস্পষ্টভাবে চোখের সামনে ফুটে উঠল সারি সারি মস্ত বড় বাড়ি, চওড়া আলশে, উঁচু থাম আর পাহাড়ের পাশে বনভূমি। হঠাৎ নিঃসীম আতঙ্কে আমি যেন উন্মাদ হয়ে গেলাম। পাগলের মতো টাইম মেশিনের দিকে ছুটে গিয়ে তাড়াতাড়ি কলকবজাগুলো ঠিক করতে শুরু করে দিলাম। দেখতে দেখতে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে উঁকি দিল অরুণদেবের সোনার মুকুট। ধূসর শিলাবৃষ্টি আরও দূরে সরে গেল, তারপর আবছা ভৌতিক ছায়ার মতো মিলিয়ে গেল কোথায়। মাথার ওপর ফিকে বাদামি রঙের পেঁজা তুলোর মতো মেঘের রাশি গাঢ় নীল আকাশের পটে আলপনা আঁকায় ব্যস্ত হয়ে পড়ল। চারপাশে উন্নত মাথায় দাঁড়িয়ে রইল উঁচু বাড়িগুলো, জলে ভিজে চিকমিক করতে লাগল তাদের অলংকরণ, এখানে-সেখানে স্তূপাকার হয়ে পড়ে রইল অগণিত অগলিত সাদা শিলাখণ্ড। এক অজানা জগতের মাঝে একা দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। খোলা বাতাসে উড়তে উড়তে মাথার ওপর ছোঁ মারতে উদ্যত বাজপাখি দেখে পায়রার মনে যে ভাবের উদয় হয়, সেইভাবেই শিউরে উঠল আমার তনুমন। আমার আতঙ্ক আর কোনও শাসনই মানলে না। বুকভরা নিঃশ্বাস নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে একসঙ্গে কবজি আর হাঁটু দিয়ে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরলাম লিভারটা! মরিয়া হয়ে গিয়েছিলাম কিন্তু একটা প্রবল ঝাঁকুনির সঙ্গে সঙ্গে উলটে গেল মেশিনটা। চিবুকে দারুণ লেগেছিল। এক হাত আসনের ওপর আর এক হাত লিভারের ওপর রেখে আর-একবার উঠে বসবার চেষ্টায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেদম হাঁপাতে লাগলাম আমি।
চিবুকের ওপর জোরালো ওই আঘাতে কেন জানি হঠাৎ আমার লুপ্ত সাহস আবার ফিরে পেলাম। সুদূর ভবিষ্যতের আশ্চর্য জগতের দিকে নিঃশঙ্ক সোৎসুক চোখে তাকালাম। কাছের একটা বাড়ির উঁচু দেওয়ালের অনেক ওপরে একটা গোলাকার জানালায় দেখলাম, মূল্যবান গরম পোশাক-পরা কয়েকটি মূর্তি। আমাকেও দেখেছিল ওরা, আমার দিকেই ওরা মুখ ফিরিয়ে ছিল।
তারপরই শুনলাম, কতকগুলো স্বর এগিয়ে আসছে আমার দিকে। সাদা স্ফিংক্স-এর পাশ দিয়ে ঝোপঝাড়ের মধ্যে দিয়ে ছুটন্ত মানুষের কাঁধ আর হাত নজরে এল। এদের মধ্যে একজন যে লনের ওপর মেশিন নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমি, ছুটে এল সেইদিকে। ছোটখাটো একটা মানুষ, ফুট চারেক উঁচু হবে। পরনে টুকটুকে লাল রঙের টিউনিক, কোমরে চামড়ার বন্ধনী, পায়ে স্যান্ডাল বা বুশকিনের মতো একরকম জুতো। হাঁটু পর্যন্ত নগ্ন, মাথাতেও কোনও টুপি নেই। তা-ই দেখেই সেই প্রথম লক্ষ করলাম, কী গরম সেখানকার বাতাস।
খুদে মানুষটাকে দেখতে কিন্তু ভারী সুন্দর। দেহে-মুখে গরিমা মাখানো, কিন্তু বর্ণনা করা যায় না এমনি শীর্ণ। ক্ষয়িষ্ণু সৌন্দর্য বলে একটা কথা প্রায় শুনে থাকি আমরা, তার আরক্ত মুখ দেখে সেই কথাই মনে পড়ল আমার। ওকে দেখেই হঠাৎ আমি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। হাত তুলে নিলাম মেশিনের ওপর থেকে।
০৫. স্বর্ণযুগ
৫৷ স্বর্ণযুগ
পরমুহূর্তে মুখোমুখি দাঁড়ালাম আমরা–আমি আর আগামীকালের সেই বিশীর্ণ মানুষটি। সিধে আমার কাছে এসে চোখে চোখ রেখে হেসে উঠল সে। ভাবভঙ্গিতে শঙ্কার লেশমাত্র না দেখে অবাক না হয়ে পারলাম না। তারপরেই সে তার সঙ্গী দুজনের দিকে ফিরে অদ্ভুত কিন্তু বড় মিষ্টি আর দ্রুত উচ্চারণে কী বললে।
আরও অনেকে ছুটে আসছিল, দেখতে দেখতে বোধহয় আট-দশজন এইরকম সুন্দর খুদে মানুষ ঘিরে ধরল আমাকে। একজন আমাকে কী বললে। আর তখনই বুঝলাম তাদের তুলনায় আমার গলার স্বর কী বিশ্রী কর্কশ আর মোটা। তাই মাথা নেড়ে কানের দিকে আঙুল তুলে দেখলাম আমি। আর-এক পা এগিয়ে আসে সে, একটু ইতস্তত করে, তারপর স্পর্শ করে আমার হাত। আরও কতকগুলো নরম ছোঁয়া অনুভব করলাম ঘাড়ে পিঠে। আমি রক্তমাংসের জীব কি না, তা-ই পরখ করে নিল ওরা। ভয় পাবার মতো কিছু নেই, বরং এদের ছেলেমানুষি স্বাচ্ছন্দ্য, মিষ্টি সৌন্দর্য দেখে মনে গভীর আস্থা জেগে ওঠে। তা ছাড়া ওরা এত রোগা যে আমার তো মনে হল, ওদের ডজনখানেককে একগোছা আলপিনের মতো ছুঁড়ে দিতে পারি। ওদের টাইম মেশিনে হাত দিতে দেখে আমাকেও এবার তৎপর হয়ে উঠতে হল। এতক্ষণে এ বিপদের সম্ভাবনা মোটেই মনে আসেনি। তাড়াতাড়ি স্টার্ট দেওয়ার লিভারটা খুলে নিয়ে পকেটে রেখে দিলাম। তারপর ভাবতে লাগলাম, কী করে কথাবার্তা শুরু করা যায়।
আরও ভালো করে ওদের চেহারা দেখতে গিয়ে ফুটফুটে সৌন্দর্যের মধ্যে কতকগুলো বৈশিষ্ট্য লক্ষ করলাম। ঢেউতোলা চুলগুলো গাল আর ঘাড়ের কাছে এসে সুচালো প্রান্তে শেষ হয়েছে। মুখের ওপর দাড়িগোঁফের কোনও চিহ্নই নেই। আর কান তো আশ্চর্য রকমের ছোট। ছোট্ট মুখের হাঁ, ঘন লাল পাতলা ঠোঁট, এতটুকু চিবুকটাও সরু হয়ে নেমে এসেছে নিচের দিকে। চোখগুলো কিন্তু বেশ বড় বড়, ভাসা ভাসা চাহনি সে চোখে।