যাত্রারম্ভের সে অস্বচ্ছন্দ অনভূতি আর ততটা তীব্র ছিল না। কীরকম জানি মূৰ্ছাবেশের মতো এক বিচিত্র অনুভূতিতে ভরে উঠেছিল আমার অন্তর। কী জানি কেন এলোমেলোভাবে দুলছিল মেশিনটা। কিন্তু আমার চিন্তাশক্তি তখন এমনই অসাড় হয়ে উঠেছে যে, দুলুনি থামাবার কোনও প্রচেষ্টা আমি করলাম না। উত্তরোত্তর বেড়ে যাওয়া একটা উন্মাদনায় অবশ হয়ে এল আমার সর্ব ইন্দ্রিয়, দুরন্ত বেগে ভবিষ্যতের গর্ভে ধেয়ে চললাম বাধাহীন গতিতে। প্রথমে গতিরোধের কোনও চিন্তাই আসেনি আমার মনে, শুধু ওই বিচিত্র অনুভূতি ছাড়া আর কোনও কিছুই উপলব্ধি করিনি তখনও। কিন্তু অচিরেই নতুন একটা চিন্তাধারা আমার মনে জেগে উঠতে লাগল–বিশেষ একটা ঔৎসুক্য আর সেই সঙ্গে বিশেষ এক আতঙ্ক–শেষে আমার সমস্ত স্নায়ুতে স্নায়ুতে ছড়িয়ে পড়ল সেই চিন্তাধারা। চোখের সামনে ধাবমান জগতের ধোঁয়াটে পটপরিবর্তন দেখে ভাবলাম, না জানি মনুষ্যত্বের কী বিচিত্র বিকাশ, আমাদের আদিম সভ্যতার কী চরম অগ্রগতিই দেখব এবার! দেখলাম, বিরাট বিরাট জমকালো স্থাপত্য নিদর্শন, আমাদের এখনকার বাড়ির চাইতে অনেক বিপুল তাদের আকৃতি, আর তবুও যেন ঝিলমিলে কুয়াশা দিয়ে তা গড়া। দেখলাম, পাহাড়ের পাশের জমি উজ্জ্বল সবুজ রঙে ঝলমল করে উঠল, এমনকী শীতের প্রকোপেও অম্লান রইল তাদের ঔজ্জ্বল্য। চেতনার বিহ্বলতা সত্ত্বেও বুঝলাম, বড় সুন্দর হয়ে উঠেছে। পৃথিবী। আর তাই এবার গতিরোধের চিন্তাই প্রবল হয়ে উঠল আমার মনে।
আর তখনই অদ্ভুত একটা ঝুঁকির সম্মুখীন হলাম আমি। যে স্থানটুকু আমি বা আমার মেশিন দখল করে রয়েছে, সেখানে অন্য কোনও বস্তু থাকা খুবই সম্ভব। সময়ের মধ্যে দিয়ে দারুণ বেগে ধেয়ে চলার সময়ে অবশ্য এসব সম্ভাবনার কোনও প্রশ্নই ওঠেনি; কেননা, এককথায় বলতে গেলে আমি সূক্ষ্মরূপে সংকীর্ণ জোড়পথে বাষ্পের মতো পিছলে যাচ্ছিলাম এক বস্তু থেকে আর-এক বস্তুর মধ্যে দিয়ে। কিন্তু হঠাৎ গতিরুদ্ধ হওয়া মানেই পথে আসা যে কোনও বস্তুর অণুতে অণু গেঁথে যাওয়া, ফলে আমার প্রতিটি পরমাণু বাধার প্রতিটি পরমাণুর সঙ্গে এমন নিবিড় সংস্পর্শে আসবে, যার পরিণামে ঘটবে একটা কল্পনাতীত রাসায়নিক বিক্রিয়া সম্ভবত দিগন্তবিস্তারী একটা বিস্ফোরণ, আর মেশিন। সমেত রেণু রেণু হয়ে সম্ভাব্য সবকিছুর মাত্রা ছাড়িয়ে কোনও অজানায় আমার মিলিয়ে যাওয়া। মেশিনটাকে তৈরি করার সময়ে এ সম্ভাবনা বারবার ভেবে দেখেছি আমি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত অপরিহার্য ঝুঁকি হিসেবে তা আমি প্রসন্ন মনেই মেনে নিয়েছিলাম–বেঁচে থাকতে গেলে যেমন একটা-না-একটা ঝুঁকি মানুষকে নিতে হয়, এ-ও অনেকটা সেইরকম আর কী! কিন্তু সত্যই যখন সে ঝুঁকির মুখোমুখি হলাম, তখন আমার হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল। অচেনা-অজানা গতিবেগ, দীর্ঘকাল ধরে পতনের গা-গুলানো অনুভূতি আর মেশিনের অবিরাম ঝাঁকুনি-দুলুনির ফলেই বোধহয় আমার স্নায়ুও আর ধাতস্থ ছিল না। আপন মনে বললাম, না, থামা উচিত হবে না কোনওমতেই; কিন্তু পরমুহূর্তেই স্থির করলাম, থামতেই হবে। ধৈর্যহীন মূর্খের মতো আচমকা ঝুঁকে পড়লাম লিভারের ওপর–তৎক্ষণাৎ পাক খেতে খেতে উলটে পড়ল মেশিনটা, আর শূন্যপথে ছিটকে গেলাম আমি।
রাশি রাশি বাজের দামামা বেজে ওঠে আমার কানের পরদায়। মুহূর্তের জন্য হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলাম আমি। চারপাশে শুনলাম শুধু শিলাবৃষ্টির হিসহিসে শব্দ আর দেখলাম, উলটে-পড়া মেশিনের সামনেই নরম ঘাসজমির ওপর বসে রয়েছি আমি। তখনও সবকিছু ধোঁয়াটে ধোঁয়াটে লাগছিল–কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই চোখের ঘোর কেটে গেল। চারপাশে ভালো করে তাকালাম। বাগানের মধ্যে ছোটখাটো একটা লনের ওপর বসে ছিলাম আমি, চারপাশে রডোডেনড্রনের ঝোঁপ; আরও দেখলাম, বরফের অবিরাম আঘাতে রডোডেনড্রনের ঘন বেগুনি আর টুকটুকে লাল রঙের মুকুলগুলি ঝরে ঝরে পড়ছে মাটির ওপর। মেশিনটাকে মেঘের মতো ঘিরে ধরে নেচে নেচে উঠছিল শিলার টুকরোগুলো, ঠিকরে গিয়ে ধোঁয়ার মতো গড়িয়ে পড়ছিল মাটির ওপর। দেখতে দেখতে ভিজে সপসপে হয়ে উঠল আমার সর্বাঙ্গ। আপ্যায়নের চমৎকার নমুনা। আপন মনেই বলি, অসংখ্য বছর পেরিয়ে যে তোমায় এল দেখতে, সে মানুষটার কী হালই করলে তুমি।
তারপরেই ভাবলাম, বোকার মতো বসে বসে ভেজার কোনও মানে হয় না। উঠে দাঁড়িয়ে চারপাশে তাকালাম। রডোডেনড্রনকুঞ্জের ওপারে অস্পষ্ট শিলাবৃষ্টির মধ্যে দিয়ে দেখলাম, সাদা পাথরে খোদাই প্রকাণ্ড একটা আবছা মূর্তি। এ ছাড়া জগতের সবকিছু রইল অদৃশ্য।
আমার তখনকার অনুভূতি বর্ণনা করা সত্যই কঠিন। শিলাবৃষ্টি যতই পাতলা হয়ে আসতে লাগল, ততই স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল সাদা মূর্তিটা। বেজায় উঁচু মূর্তি, একটা সিলভার বা গাছ তো কাঁধের কাছে গিয়ে ঠেকেছিল। আগাগোড়া সাদা মর্মরে তৈরি তার দেহ, আকারে অনেকটা ডানাওয়ালা স্ফিংক্স-এর মতো, কিন্তু ডানা দুটো খাড়াইভাবে নিচে নেমে এসে শুন্যে মেলা রয়েছে, যেন উড়তে গিয়ে হঠাৎ স্থাণু হয়ে গেছে। বেদিটা মনে হল ব্রোঞ্জের তৈরি, ওপরে পুরু হয়ে জমে রয়েছে সবুজ কলঙ্ক। মুখটা ফেরানো ছিল আমার দিকেই, দৃষ্টিহীন চোখ দুটো যেন আমাকেই লক্ষ করছিল, ঠোঁটের কোণ ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়ছিল হাসির ছায়া। রোদে-জলে ক্ষয়ে এসেছে মূর্তিটা, দেখলে জরাগ্রস্ত বলে মনে হয়। বেশ কিছুক্ষণের জন্যে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলাম–আধ মিনিট কি আধ ঘণ্টা তা জানি না। মূর্তির সামনে আছড়ে-পড়া শিলাবৃষ্টির চাদর কখনও গাঢ়, কখনও ফিকে– আর সেই সঙ্গে মূর্তিটাও যেন কখনও যাচ্ছে পিছিয়ে, কখনও আসছে এগিয়ে। শেষকালে ক্ষণেকের জন্যে জোর করে চোখ ফিরিয়ে দেখলাম, শিলাবৃষ্টির ঘন পরদা দ্রুত ফিকে হয়ে যাচ্ছে, সূর্যের স্বাক্ষর বুকে নিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠছে নীল আকাশ।