গত বৃহস্পতিবার আপনাদের কয়েকজনকে টাইম মেশিনের মূলসূত্রগুলি আমি বুঝিয়ে দিয়েছি। অসমাপ্ত মেশিনটাও ল্যাবরেটরিতে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছি। এখনও সেখানেই আছে মেশিনটা–এতটা পথ ঘুরে আসার ফলে একটু ময়লা হয়ে গেছে অবশ্য। তা ছাড়া হাতির দাঁতের একটা রড চিড় খেয়ে গেছে, তামার রেলিংটাও গেছে বেঁকে। বাদবাকি সব ঠিক আছে। ভেবেছিলাম, গত শুক্রবারেই শেষ হয়ে যাবে মেশিনটা, কিন্তু শুক্রবারে কাজ যখন প্রায় শেষ হয়ে এসেছে, দেখলাম, একটা নিকেল রড প্রায় ইঞ্চিখানেকের জন্যে ছোট হচ্ছে। কাজেই নতুন করে তৈরি করতে হল রডটা। সেই কারণেই বেশ খানিকটা দেরি হয়ে গেল। আজ সকালে সম্পূর্ণ হল টাইম মেশিন। আর সকাল দশটার সময়ে শুরু হল তার জীবনযাত্রা। চারদিকে টোকা মেরে স্কুগুলো আর-একবার দেখে নিয়ে কোয়ার্টজ রডে আরও এক ফোঁটা তেল ঢেলে দিলাম। তারপর চেপে বসলাম আসনে। খুলির কাছে পিস্তল ধরে আত্মহত্যা করার আগে মানুষের মনে যে বিচিত্র ভাবের উদয় হয়, আমারও হল তা ই। এক হাতে স্টার্ট দেওয়ার লিভারটা ধরে, অপর হাতে বেশ করে চেপে ধরলাম গতিরোধের লিভারটা। তারপর প্রথমটা ঠেলার পরমুহূর্তেই দ্বিতীয়টাও ঠেলে দিলাম। মনে হল, মাথা ঘুরে গেল আমার। দুঃস্বপ্নের ঘোরে মনে হল যেন তলিয়ে যাচ্ছি অতলে, আর তারপরেই চারপাশে তাকিয়ে দেখি, ঠিক আগের মতো অবস্থাতেই ল্যাবরেটরিতে রয়েছি আমি। কিছুই তো তাহলে হল না! মুহূর্তের জন্য সন্দেহ হল, বুঝি-বা আমার মেধা শেষ পর্যন্ত ছলনা করলে আমায়। পরক্ষণেই আমার চোখ পড়ল ঘড়ির ওপর। এক মুহূর্ত আগেও তো ঘড়ির কাঁটা দাঁড়িয়েছিল দশটা, কি খুব জোর দশটা বেজে এক মিনিটের ঘরে। আর এখন দেখলাম, কাঁটা দুটো ঘুরে এসে দাঁড়িয়েছে সাড়ে তিনটের ঘরে।
জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে দু-হাতে আঁকড়ে ধরলাম স্টার্ট দেওয়ার লিভারটা, আর পরক্ষণেই এক ধাক্কায় ঠেলে দিলাম সামনের দিকে। ধোঁয়ার মতো আবছা হয়ে এল ল্যাবরেটরি, রাশি রাশি আঁধারে ভরে উঠতে লাগল ঘরটা। মিসেস ওয়াচেট ভেতরে এলেন, আমাকে যেন দেখতে পাননি এমনিভাবে এগিয়ে গেলেন বাগানের দরজার দিকে। পথটুকু পেরতে বোধহয় তাঁর মিনিটখানেক লেগেছিল, আমার কিন্তু মনে হল যেন রকেটের মতো সাঁত করে বেরিয়ে গেলেন তিনি। এবার একেবারে শেষ ঘাঁটিতে ঠেলে দিলাম লিভারটা। ফুঁ দিয়ে প্রদীপ নিবিয়ে দেওয়ায় মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল নিশার তমসা, পরের মুহূর্তেই রাত কেটে গিয়ে ফুটে উঠল ভোরের আলো। অস্পষ্ট আর আবছা হয়ে উঠতে লাগল ল্যাবরেটরি, আরও অস্পষ্ট… আরও… আরও। আবার রাত এল ঘনিয়ে, তারপরে আবার দিন, আবার রাত, আবার দিন–ক্রমশ অস্পষ্ট ভোমরার গুঞ্জনের মতো একটা ধ্বনি আবর্তের পর আবর্ত রচনা করে চলল আমার কর্ণকুহরে, আর-একটা অজানা, বোবা বিমূঢ়তা চেপে বসতে লাগল আমার মনের ওপর।
সময়-পর্যটনের সে অদ্ভুত অনুভূতি আপনাদের আমি বোঝাতে পারব না। অত্যন্ত অস্বস্তিকর, অস্বচ্ছন্দ সে-অনুভূতি। অসহায় অবস্থায় তিরের মতো সামনের দিকে উন্মাদ বেগে ছুটে যাওয়ায় যে-অনুভূতি, এ যেন অনেকটা তা-ই। যে-কোনও মুহূর্তে একটা প্রবল সংঘাতের আশঙ্কায় শিউরে উঠল আমার অন্তর। যতই এগিয়ে চললাম, কালো ডানা ঝাঁপটানোর মতো রাত কেটে গিয়ে ফুটে উঠতে লাগল দিনের আলো। দূর হতে দূরে সরে যেতে লাগল ল্যাবরেটরির ধোঁয়াটে রেখা–দেখলাম, আকাশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্তে এক-এক লাফে এগিয়ে চলেছে সূর্য, এক-এক লাফে কাটছে এক-একটি মিনিট আর প্রতিটি মিনিট সূচনা করছে এক-একটি দিনের। মনে হল, ল্যাবরেটরি যেন ধ্বংস হয়ে মিলিয়ে গেল শূন্যে–খোলা বাতাসে এসে পড়লাম আমি। ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগল গতিবেগ। ধীরগতি শামুকও চোখের পলকে মিলিয়ে যেতে লাগল দৃষ্টিপথের বাইরে। আঁধার আর আলোকের ঘন ঘন আনাগোনা বেজায় যন্ত্রণাদায়ক হয়ে উঠল আমার চোখে। তারপরেই দেখলাম, সবিরাম আঁধারের মাঝে দ্রুতগতিতে কলা পরিবর্তন করে অমাবস্যা থেকে পূর্ণিমা আর পূর্ণিমা থেকে অমাবস্যার পথে গড়িয়ে চলেছে চন্দ্র–চারপাশে অস্পষ্টভাবে ঝিকমিক করছে ঘূর্ণমান তারার রাশি। দেখতে দেখতে গতি আরও বেড়ে যেতে দিনরাতের স্পন্দন টানা একটা ধূসর রেখায় মিশে এক হয়ে গেল। আশ্চর্য গাঢ় নীল রঙে ঘন হয়ে উঠল আকাশ, গোধূলির শুরুতে যেমন সুন্দর বর্ণচ্ছটা ছড়িয়ে পড়ে, এ যেন তেমনি। সূর্যের ঘন ঘন লাফ মিলিয়ে গিয়ে দেখা গেল শুধু আগুনের একটা টানা রেখা, যেন মহাশূন্যের মাঝে জ্বলজ্বলে এক তির্যক খিলান। আর অস্পষ্টভাবে বাঁকা রেখার মাঝে জ্বলতে-নিবতে লাগল চাঁদ। তারপর আর কোনও তারাই দেখতে পেলাম না, শুধু ঘন নীলের মাঝে একটা জ্বলজ্বলে বৃত্তের দপদপানি জেগে রইল আমার চোখের সামনে। চারপাশে দৃশ্যপটও কুয়াশার মতো অস্পষ্ট হয়ে উঠল। যে-পাহাড়ের নিচে দাঁড়িয়ে এ বাড়িটা, তার সামনেই দাঁড়িয়েছিলাম আমি। ধোঁয়ার মতো ধূসর পাথরের রেখা আমার অনেক উঁচুতে উঠে গিয়েছিল। দেখলাম, চোখের সামনে বৃদ্ধি পাচ্ছে গাছের সারি। এক এক ফুৎকারে পালটে যাচ্ছে তার আকৃতি। বাদামি থেকে সবুজ, তারপরেই ধূসর। এরপরেই ডালপালা ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া হয়ে উঠে কাঁপতে কাঁপতে গেল শুকিয়ে। দেখলাম, বড় বড় প্রাসাদ গড়ে উঠছে, সুন্দর কিন্তু আবছা, তারপর মিলিয়ে যাচ্ছে স্বপ্নের মতো। সমস্ত ভূতল মনে হল পালটে যাচ্ছে, চোখের ওপর গলে গলে স্রোতের মতো বয়ে চলেছে। ডায়ালের ওপর গতিনির্দেশক ছোট কাঁটাগুলোর গতি দ্রুত থেকে দ্রুততর হয়ে উঠল। ক্ষণ পরেই দেখলাম, কর্কটক্রান্তি থেকে মকরক্রান্তির মধ্যে দুলছে সূর্যবলয় রেখা এক মিনিটেরও অল্প সময়ের মধ্যে, ফলে এক-এক মিনিটে পেরিয়ে যেতে লাগলাম এক-একটি বছর! আর মিনিটে মিনিটে সাদা তুষার-চাদর ঝলসে উঠতে লাগল পৃথিবীর ওপর, আর পলকের মধ্যে তা মিলিয়ে গিয়ে ফুটে উঠতে লাগল সংক্ষিপ্ত বসন্তের ঝকঝকে সবুজাভা।