পুরো এক মিনিট সব চুপচাপ। মনোবিজ্ঞানীর বোধহয় কিছু বলার ইচ্ছে ছিল কিন্তু কী ভেবে তিনিও বোবা হয়ে গেলেন।
সরু একটা লিভারের ওপর হাত রাখলেন সময়-পর্যটক। তারপরেই চট করে বললেন, না, আপনিই আসুন। এগিয়ে দিন আপনার আঙুল।
ভয়ে ভয়ে তর্জনী এগিয়ে দেন মনোবিজ্ঞানী। সময়-পর্যটক আঙুলটা দিয়ে ঘুরিয়ে দিলেন লিভারটা।
চোখের সামনে দেখলাম, লিভারটা ঘুরে গেল। কোনও হাতসাফাই নেই, চোখের ধাঁধা নেই। কোনওরকম চালাকি থাকা সম্ভবও নয়। কিন্তু পরক্ষণেই এক ঝলক বাতাসে লাফিয়ে উঠল ল্যাম্পের আকাঁপা শিখাটা। দপ করে নিবে গেল ম্যান্টেলের ওপর রাখা একটা মোমবাতি।
আর, টেবিলের ওপর ছোট্ট মেশিনটা দুলতে শুরু করল। দেখতে দেখতে অস্পষ্ট হয়ে গেল তার নিখুঁত ধাতব অঙ্গ। সেকেন্ডখানেকের জন্য চিকমিকে তামা আর হাতির দাঁতের একটা ফিকে ভৌতিক ছায়া দুলে উঠল ছায়া-মায়ার মাঝে। আর তারপরেই অদৃশ্য হয়ে গেল সেটুকুও। ল্যাম্প ছাড়া টেবিলের ওপর আর রইল না কিছুই।
ঠিক পুরো একটা মিনিট কারও মুখে কোনও কথা ফুটল না।
সংবিৎ ফিরে পেয়ে প্রথমে মনোবিজ্ঞানীই হেঁট হয়ে টেবিলের তলাটা দেখলেন।
আর প্রসন্ন মুখে হাসতে লাগলেন সময়-পর্যটক। ধীর-পায়ে এগিয়ে গেলেন ম্যান্টলপিসের সামনে–পাইপটা বার করে তামাক ঠাসতে লাগলেন আপন মনে।
হতভম্বের মতো আমরা এর-ওর মুখের দিকে তাকালাম। ডাক্তার ফস করে বলে ওঠেন, আরে মশাই, আপনি কি সত্যই ভেবেছেন যে, ওই বিদঘুটে মেশিনটা সময়ের পথে হাওয়া খেতে গেল?
কোনও সন্দেহই নেই সে-বিষয়ে। পাইপে আগুন লাগিয়ে মনোবিজ্ঞানীর দিকে ফিরে দাঁড়ান সময়-পর্যটক। মোটেই ঘাবড়ে যাননি, এমনি ভাব দেখিয়ে মনোবিজ্ঞানী ভদ্রলোক তাড়াতাড়ি কাঁপা হতে একটা সিগারেট ধরাবার চেষ্টা করতে লাগলেন। মুচকি হেসে বলে চললেন সময়-পর্যটক, ল্যাবরেটরিতে বেশ বড় সাইজের একটা মেশিন শেষ হয়ে এল প্রায়। তারপর তো ইচ্ছে আছে, নিজেই একদিন বেরোব।
এরপর আমরা কেউ আর কোনও কথা বললাম না। অথবা বলবার চেষ্টা করেও পারলাম না। সকৌতুকে আমাদের বিস্ময়-আঁকা মুখগুলোর ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন উনি, তারপর বললেন, আসুন, আসল টাইম মেশিনটা দেখাই আপনাদের।
বলে, একটা মোমবাতি নিয়ে পা বাড়ালেন বারান্দার পথে। পিছুপিছু চুম্বকে টানা লোহার মতো আমরাও এগিয়ে গেলাম। লম্বা টানা বারান্দার দেওয়ালে আমাদের লম্বা ছায়াগুলো মোমবাতির কাঁপা শিখায় কেঁপে কেঁপে উঠে কেমন জানি শিরশিরে ভাবে ভরিয়ে দিল আমার অন্তর।
ল্যাবরেটরিতে এসে যা দেখলাম, তা ড্রয়িং রুমে চোখের সামনে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া খুদে মেশিনটারই বিরাট সংস্করণ। কতকগুলো অংশ চকচকে নিকেলের তৈরি, সাদা হাতির দাঁতের কাজও দেখলাম কয়েক জায়গায়। পাথরে ক্রিস্টালও বসানো আছে এখানে সেখানে। মেশিনটা প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে এলেও কতকগুলো কোনো ক্রিস্টালের ডান্ডা তখনও পড়ে ছিল পাশের বেঞ্চে। একটা তুলে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখলাম–মনে হল কোয়ার্টজের তৈরি।
ডাক্তার বললেন, আপনি কি মশাই তামাশা জুড়েছেন, না সত্যিই সময়ের পথে ঘুরে বেড়ানোর মতলব আঁটছেন?
মাথার ওপর বাতিটা তুলে ধরে বললেন সময়-পর্যটক, এই মেশিনে বসেই আমি। আমার অভিযান চালাব সময়ের বুকে–এই আমার প্রতিজ্ঞা। জীবনে এর চাইতে বেশি সিরিয়াস যে আর আমি হইনি–তা আপনারা বিশ্বাস করতে পারেন।
০৩. সময়-পর্যটকের প্রত্যাবর্তন
৩। সময়-পর্যটকের প্রত্যাবর্তন
তখনও কিন্তু আমাদের কেউই টাইম মেশিনকে মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে উঠতে পারেনি। দুনিয়ায় একশ্রেণির মানুষ আছে, যাদের চতুরতার পরিমাপ করা সাধারণ মানুষের সাধ্য নয়। চতুর-চূড়ামণি সময়-পর্যটকও এই শ্রেণির মানুষ। নিত্যনতুন ফন্দি যাঁর মাথায় অহরহ গজাচ্ছে, তাঁর সব কথা হট করে বিশ্বাস করে বোকা বনতে মন চায় না কিছুতেই। ডাক্তারের সঙ্গে এ-বিষয়ে পরে আমার কথা হয়েছিল। তিনি তো বললেন, এ একটা রীতিমতো উন্নত ধরনের ম্যাজিক ছাড়া কিছুই নয়। মোমবাতি নিবে যাওয়ার সঙ্গে মেশিন উধাও হওয়ার নিশ্চয় সম্পর্ক আছে। কিন্তু সে-সম্পর্কটা যে কী তা তিনি অনেক গবেষণা করেও আবিষ্কার করতে পারলেন না।
সেদিন সময়-পর্যটকের ড্রয়িং রুমে কয়েকজন রোজকার অতিথির মধ্যে আমিও ছিলাম। তাই পরের বেস্পতিবার যথাসময়ে হাজির হলাম রিচমন্ডে। গিয়ে দেখি আমার আগেই জনা চার-পাঁচ ভদ্রলোক জমায়েত হয়েছেন। একতাল কাগজ হাতে আগুনের চুল্লির সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন ডাক্তার। কিন্তু আশপাশে কোথাও সময়-পর্যটকের টিকিটি দেখতে পেলাম না।
সাড়ে সাতটা বেজে গেল, ডাক্তারই প্রথমে কথা বললেন, এবার ডিনার শুরু করা উচিত, কী বলেন?
কিন্তু গৃহস্বামী গেলেন কোথায়? শুধাই আমি।
এখনও এসে পৌঁছাননি। অবশ্য আমাকে একটা চিরকুটে লিখে গেছেন যে, তাঁর জন্য অপেক্ষা না করে আমরা যেন সময়মতো ডিনার খেয়ে নিই।
ডিনার ঠান্ডা হতে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয় মোটেই। বললেন নামকরা একটা দৈনিক সম্পাদক।
সুতরাং ঘণ্টা বাজিয়ে ডিনারের আদেশ দিলেন ডাক্তার।
অভ্যাগতদের মধ্যে আমি আর ডাক্তার ছাড়াও ছিলেন মনোবিজ্ঞানী, ব্ল্যাঙ্ক নামধারী সম্পাদক ভদ্রলোক, আরও দু-জন সাংবাদিক। এঁদের মধ্যে আবার দাড়িওয়ালা ভদ্রলোকটি এমনই মুখচোরা যে, সারাটা সময় একবারও মুখ খুলতে দেখলাম না তাঁকে। ছুরি-কাঁটার সঙ্গে সমানে মুখও চলতে শুরু করে। গত হপ্তার রোমাঞ্চকর এক্সপেরিমেন্টের হাতসাফাইয়ের বর্ণনাটা বেশ রসিয়ে রসিয়ে শোনাচ্ছেন মনোবিজ্ঞানী, সম্পাদকমশাইও তাল মিলিয়ে মাঝে মাঝে রসালো টিপ্পনী ছাড়ছেন, এমন সময়ে কোনওরকম শব্দ না করে খুব আস্তে আস্তে বারান্দার দরজাটা ফাঁক হয়ে যেতে লাগল।