তারপরেই থামালাম মেশিনটা। চারদিকে তাকিয়ে আবার দেখতে পেলাম আমার পরিচিত ল্যাবরেটরি, যন্ত্রপাতি আর টুকটাক সরঞ্জাম–ঠিক যেভাবে ফেলে গিয়েছিলাম, সেইভাবেই পড়ে রয়েছে এখানে-ওখানে। টলতে টলতে মেশিন থেকে নেমে পাশের বেঞ্চে বসলাম। বেশ কয়েক মিনিট কেঁপে জ্বর আসার মতো দারুণভাবে কাঁপতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর অনেকটা সামলে নিলাম। চারপাশে আগের মতোই রয়েছে আমার পুরানো কারখানা, কিছুই পালটায়নি। ভাবলাম, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। স্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই দেখিনি আমি।
কিন্তু তা তো নয়! ল্যাবরেটরির দক্ষিণ-পূর্ব কোণ থেকে যাত্রা শুরু করেছিল টাইম মেশিন, কিন্তু শেষ হয়েছে উত্তর-পশ্চিমের দেওয়ালের ধারে–সেখানেই এখনও দেখতে পাবেন মেশিনটা। আর এই দূরত্বটুকুই ছিল ছোট লন আর সাদা স্ফিংক্স-এর বেদির মধ্যে -মর্লকরা এই পথটুকুই বয়ে নিয়ে গিয়েছিল টাইম মেশিনটা। বেশ কিছুক্ষণ অসাড় হয়ে রইল আমার মগজ। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে প্যাসেজ দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এলাম এদিকে। দরজার পাশেই টেবিলের ওপর পলমল গেজেটটা দেখলাম। আপনাদের টুকরো টুকরো কথা আর ছুরি-কাঁটার শব্দ শুনতে পেলাম। বড় দুর্বল লাগছিল নিজেকে, তাই একটু ইতস্তত করলাম। কিন্তু মাংসের লোভনীয় সুবাস নাকে আসতেই দরজা খুলে দেখলাম আপনাদের। তারপর কী হল তা তো জানেনই। হাত-মুখ ধুয়ে খাওয়াদাওয়া সেরে এই আশ্চর্য কাহিনি শোনাতে বসেছি আপনাদের।
১৬. কাহিনির পর
১৬। কাহিনির পর
একটু থেমে আবার বললেন তিনি, ভাবছেন, মস্ত বড় একটা আষাঢ়ে গল্প শুনিয়ে দিলাম। কিন্তু অ্যাডভেঞ্চারের গল্পটা আপনাদের বলার জন্যে যে ফিরে এসেছি তা-ও তো ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না আমি। ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন, বিশ্বাস করুন, এতটা আশা করা সত্যিই উচিত হয়নি আমার। ধরে নিন, সবটাই ডাহা মিথ্যে, নিছক একটা ভবিষ্যদ্বাণী। ধরে নিন, কারখানায় বসে একটা আজগুবী স্বপ্ন দেখেছি। না-হয় ভাবতে পারেন, মানুষজাতির ভবিষ্যৎ পরিণতি ভাবতে ভাবতে শেষ পর্যন্ত এই গাঁজাখুরি উপন্যাসটাই ফেঁদে বসেছি। নিছক গল্প হিসাবে ধরেই বলুন তো কেমন লাগল আপনাদের?
পাইপটা তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে ঠুকতে লাগলেন তিনি। ক্ষণকালের জন্য গভীর নৈঃশব্দ্য নেমে এল ঘরে। তারপরেই শুরু হল চেয়ার টানার জুতোর মসমস শব্দ। অন্ধকারের মধ্যে তাকিয়ে দেখি, পলকহীন চোখে ডাক্তার লক্ষ করছেন সময়-পর্যটককে। সম্পাদক তাঁর ছনম্বর সিগারেটটার ডগায় চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছেন। সাংবাদিক ঘড়ি হাতড়াচ্ছেন। বাকি সবাই একেবারে নিশ্চল।
দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালেন সম্পাদক। কী দুর্ভাগ্য আমাদের, আপনি গল্প-লেখক হতে পারলেন না!
আপনি তাহলে বিশ্বাস করেননি?
আরে মশাই–।
তাহলে করেননি। আমার দিকে ফিরলেন সময়-পর্যটক। দেশলাইটা দিন তো… বিশ্বাস কি আমিও করেছি… কিন্তু…
হঠাৎ ওঁর চোখ পড়ল টেবিলের ওপর রাখা শুকনো সাদা ফুল দুটোর ওপর। তারপরেই আঙুলের গাঁটের প্রায় শুকনো কাটাছেঁড়াগুলোর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলেন। ল্যাম্পের কাছে এসে ফল দুটো নেড়েচেড়ে দেখলেন ডাক্তার। বিড়বিড় করে ওঠেন তিনি।
সাংবাদিক বলেন, একটা বাজতে চলল, এবার তাহলে বাড়ি যাওয়া যাক, কী বলেন?
মনোবিজ্ঞানী বললেন, অনেক ট্যাক্সি মিলবে এখন।
ডাক্তার বললেন, ফুলগুলো দেখতে কিন্তু অদ্ভুত। এগুলো নিয়ে যেতে পারি কি?
ইতস্তত করেন সময়-পর্যটক, তারপর দ্বিধা কাটিয়ে স্পষ্ট বলেন, নিশ্চয় না।
সত্যি করে বলুন তো কোত্থেকে জোগাড় করলেন ওগুলো? শুধালেন ডাক্তার। দুহাতে মাথা চেপে ধরেন সময়-পর্যটক। একটু চুপ করে থেকে মৃদু কণ্ঠে বললেন, উইনা রেখেছিল আমার পকেটে। কিন্তু… কিন্তু এসব কি সত্যি না কল্পনা? সত্যিই কি আমি কোনওদিন টাইম মেশিন বা তার মডেল তৈরি করেছিলাম? স্বপ্ন, না পাগল হলাম আমি? নাঃ, মেশিনটা দেখতেই হবে আমাকে!
চট করে ল্যাম্পটা তুলে নিয়ে করিডরের দিকে এগিয়ে গেলেন উনি, পিছুপিছু আমরাও গেলাম। ল্যাম্পের কাঁপা আলোয় দেখলাম দেওয়ালের গায়ে খাড়া মেশিনটা, বিদঘুটে স্কুল তার গড়ন, তামা আবলুশ, হাতির দাঁত আর স্বচ্ছ কোয়ার্টজে চিকমিকে তার শ্রীহীন অঙ্গ। স্বপ্ন যে নয়, তা কঠিন ধাতুর রেলিং স্পর্শ করেই বুঝলাম, হাতির দাঁতের ওপর লেগেছে বাদামি ছোপ, এখানে-সেখানে কাদার দাগ, নিচের অংশে ঘাস আর শেওলার কুচি, একটা রেলিং বেঁকে গেছে। ল্যাম্পটা বেঞ্চির ওপর রেখে বেঁকা রেলিং-এ হাত বুলিয়ে বললেন সময়-পর্যটক, স্বপ্ন নয় তাহলে। যে কাহিনি আপনাদের বললাম, তার প্রতিটি অক্ষর সত্য। বলে ল্যাম্পটা তুলে নিয়ে আমাদের সঙ্গে নিঃশব্দে ফিরে এলেন স্মোকিং রুমে।
বিদায় নেওয়ার সময় একটু ইতস্তত করে ডাক্তার বললেন, আপনি দিনকতক বিশ্রাম নিন, অতিরিক্ত পরিশ্রম করছেন আজকাল। উত্তরে হা হা করে হেসে উঠলেন সময় পর্যটক।
সম্পাদকের সঙ্গে একই ট্যাক্সিতে ফিরলাম আমি। ভদ্রলোক তো ডাহা মিথ্যে বলে সবকিছু উড়িয়ে দিলেন। আমার পক্ষে কিন্তু অত চট করে কোনও সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব হল না। গল্পটা যেমন আজগুবি আর অবিশ্বাস্য, বলার ভঙ্গিও তেমনি বিশ্বাস্য যুক্তিসংগত। ঠিক করলাম, আবার দেখা করতে হবে সময়-পর্যটকের সঙ্গে। এইসব কথা ভেবে সারারাত ভালো করে ঘুমাতেই পারলাম না আমি।