কোনওরকম জীবিত প্রাণীর আশায় চারপাশে তাকালাম। কিন্তু বৃথা সে চেষ্টা। আকাশে, পৃথিবীতে, সাগরে–কিছুই নড়তে দেখলাম না। প্রাণের চিহ্ন শুধু ছিল পাহাড়ের ওপর সবুজ উদ্ভিদের মধ্যে। সমুদ্রে নিচু একটা বালির চড়া উঠে এসেছে দেখলাম, তীরভূমি থেকেও জল সরে গেছে অনেক দূরে। মনে হল, দূরে বালির চড়ায় কালোমতো একটা জিনিস যেন ঝটপট করে উঠল, কিন্তু সেদিকে তাকাতেই থেমে গেল নড়াচড়া। আমারই চোখের ভুল, পাথর ছাড়া কিছুই দেখিনি। আকাশের তারাগুলো অবশ্য খুব জ্বলজ্বলে মনে হল, অনেকদিনের চেনা পুরানো বন্ধুর মতো মিটমিট করে ওরা তাকিয়ে ছিল আমার দিকে।
আচমকা লক্ষ করলাম, পশ্চিমে সূর্যের বাইরের গোল রেখা পালটে যাচ্ছে, বাঁকা রেখার একটা জায়গায় যেন বড় রকমের একটা টোল পড়েছে। চোখের সামনে দেখলাম, বড় হয়ে যাচ্ছে টোলটা। পুরো এক মিনিট ক্রমশ এগিয়ে আসা রাশি রাশি অন্ধকারের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম, তারপর বুঝলাম, গ্রহণ শুরু হল। হয় চাঁদ আর না-হয় বুধ গ্রহ আড়াআড়িভাবে যাচ্ছে সূর্যের ওপর দিয়ে। প্রথমে চাঁদ বলেই ভেবেছিলাম, কিন্তু পরে অনেক ভেবে দেখলাম, পৃথিবী আর সূর্যের মধ্যেকার একটি গ্রহকেই সেদিন পৃথিবীর খুব কাছ দিয়ে যেতে দেখেছিলাম।
অন্ধকার ঘন হয়ে উঠতে লাগল। পূর্বদিক থেকে নতুন তেজে বয়ে এল ঠান্ডা বাতাস। আকাশ থেকে সাদা বরফ-বৃষ্টি আরও বেড়ে উঠল। সমুদ্রের কিনারা থেকে ভেসে এল অদ্ভুত ছলছল শব্দের সঙ্গে কীসের ফিসফিসানি। এইসব প্রাণহীন শব্দ ছাড়া পৃথিবী একেবারে নিস্তব্ধ। নিস্তব্ধ? সে নৈঃশব্দ্য যে কী তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। পাখির যে কুজন, মানুষের সাড়া, ভেড়ার ডাক, পোকামাকড়ের গুনগুনানি আর স্পন্দন সূচনা করে জীবন, সেসবই থেমে গেছে। অন্ধকার যত ঘন হতে লাগল, ততই বাড়তে লাগল বরফ পড়া, ততই কনকনে হয়ে উঠতে লাগল বাতাস। শেষে, একে একে কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি দূরের পাহাড়ের চুড়াগুলো হারিয়ে গেল অন্ধকারের আড়ালে। গোঙিয়ে কেঁদে উঠল বাতাস। দেখলাম, গ্রহণের ঠিক কেন্দ্রের কালো ছায়াটা আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। পরের মুহূর্তেই শুধু ফ্যাকাশে তারাগুলো দেখা গেল, আর সবকিছুই গেল অস্পষ্ট হয়ে। আকাশ ঢেকে গেল নিবিড় তিমিরে।
এই মহাতিমিরের আতঙ্ক চেপে বসল আমার ওপর। দারুণ শীতে হাড়সুদ্ধ কনকনিয়ে উঠছিল, নিঃশ্বাস নিতেও যন্ত্রণা বোধ করছিলাম। থরথরিয়ে কেঁপে উঠলাম, দারুণ গা বমি-বমি ভাব পাক দিয়ে উঠল সর্বাঙ্গে। তারপরেই লাল মুগুর পড়ার মতো সুর্যের কিনারা বেরিয়ে এল আকাশে। নিজেকে সামলাতে মেশিন থেকে নেমে দাঁড়ালাম আমি। মাথা ঘুরতে লাগল আমার, মনে হল ফিরে যাওয়ার মতো ক্ষমতাও আর নেই। অর্ধ-অচেতন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ দেখলাম, সেই জিনিসটা আবার নড়ে উঠল লাল জলের মাঝে –এবার তার নড়ে ওঠা সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহ রইল না আমার। ফুটবল কি তার চাইতেও বড় গোলাকার একটা বস্তু, গা থেকে কতকগুলো শুড় বেরিয়ে এসেছে। ছলছলে রক্তের মতো লাল জলের বুকে জিনিসটা মনে হল ঘোর কালো রঙের, এদিকে-ওদিকে দিব্যি লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরছিল জিনিসটা। তারপরেই মনে হল, অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছি আমি। কিন্তু দূর ভবিষ্যতের ওই ভয়াবহ গোধূলিতে অসহায় অবস্থায় পড়ে থাকার আতঙ্কই আমাকে কোনওরকমে টেনে এনে বসিয়ে দিলে টাইম মেশিনের আসনে।
১৫. সময়-পর্যটকের প্রত্যাবর্তন
১৫৷ সময়-পর্যটকের প্রত্যাবর্তন
আর তাই ফিরে এলাম আমি। নিশ্চয় বহুক্ষণ জ্ঞান হারিয়ে পড়ে ছিলাম মেশিনের ওপর। দিনরাতের মিটমিটে জ্বলা-নেবা আবার শুরু হল, আবার সোনালি হয়ে উঠল সূর্য, আকাশ নীল। আরও সহজভাবে নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম আমি। জমির ওঠানামার রেখা-তরঙ্গ কমে এল–মসৃণ হয়ে উঠল তার গতি। ডায়ালের ওপর পেছনদিকে ঘুরে চলল কাঁটাগুলো। আবার দেখতে পেলাম ক্ষয়িষ্ণু মানবজাতির নিদর্শন বড় বড় বাড়ির আবছা ছায়া। তা-ও গেল মিলিয়ে, এল অন্য দৃশ্য। দেখতে দেখতে লক্ষের কাঁটা শূন্যের ঘরে এসে দাঁড়াতে গতি কমিয়ে দিলাম। অনেকদিনের চেনা আমাদের সুন্দর বাড়িঘরদোর আবার দেখতে পেলাম, হাজারের কাঁটা যেখান থেকে শুরু হয়েছিল, সেখানে এসে থেমে গেল। দিনরাতের আনাগোনা আরও কমে এল। তারপরেই ল্যাবরেটরির পুরানো দেওয়াল ফিরে এল আমার চারপাশে। খুব সাবধানে আরও কমিয়ে দিলাম মেশিনের গতি।
ছোট্ট কিন্তু বেশ মজার একটা জিনিস লক্ষ করলাম। আগেই বলেছি আপনাদের, যাত্রা শুরু করার মিনিটকয়েকের মধ্যে খুব অল্প গতিবেগের সময়ে মিসেস ওয়াচেটকে ঘরের মধ্যে দিয়ে রকেটের মতো হেঁটে যেতে দেখেছিলাম। ফেরবার সময়ে ঠিক সেই মিনিটটাও পেরিয়ে আসতে হল আমাকে। কিন্তু এখন দেখলাম, সমস্ত জিনিসটা ঘটল উলটোদিক থেকে। উলটোদিক থেকে ফিল্ম চালালে যেরকম দেখা যায়, ঠিক সেইরকমভাবে আগে নিচের দরজাটা খুলে গেল, পিঠটা সামনের দিকে রেখে যেন পিছলে ল্যাবরেটরিতে ঢুকলেন মিসেস ওয়াচেট। আর ওইভাবেই পিছু হেঁটে পেছনের যে দরজা দিয়ে আগে তিনি ঢুকেছিলেন, সেই দরজা দিয়েই বেরিয়ে গেলেন! ঠিক তার আগেই মনে হল, হিলিয়ারকেও মুহূর্তের জন্য দেখলাম, কিন্তু সে-ও বিদ্যুৎ-চমকের মতো চকিতে উধাও হয়ে গেল।