ঢালু সমুদ্রতীরের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল মেশিনটা। দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে পানসে আকাশের পটে দিক্রেখায় গিয়ে মিশেছে সমুদ্র। অদ্ভুত শান্ত তার জল। না আছে ঢেউ, না আছে। আলোড়ন, কেননা বাতাসে চাঞ্চল্য নেই এতটুকুও। খুব মৃদু শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো স্পন্দিত হচ্ছিল তার জল, খুব ধীরভাবে একটু উঠে আবার নেমে যাচ্ছিল মসৃণভাবে, তাই দেখেই বোঝা গেল, চিরন্তন সমুদ্র এখনও বেঁচে আছে, এখনও হারায়নি সে তার গতি। তীরের কাছে পুরু নুনের মতো একটা স্তর দেখলাম, পাণ্ডুর আকাশের নিচে লালচে হয়ে উঠেছে তার রং। মাথার মধ্যে একটু যন্ত্রণা বোধ করছিলাম। লক্ষ করলাম, খুব দ্রুত নিঃশ্বাস নিতে হচ্ছে আমায়। পাহাড়ে ওঠার সময়ে যেরকম হয়, সেইরকম। তাইতেই বুঝলাম, এখনকার চাইতে অনেক লঘু হয়ে গেছে তখনকার বাতাস।
অনেক দূরে জনশূন্য বেলাভূমির ওপর কর্কশ, আর্ত-চিৎকার শুনে দেখি, অতিকায় প্রজাপতির মতো সাদা একটা প্রাণী কাত হয়ে ডানা পতপত করে আকাশে উঠল, তারপর কয়েকটা পাক দিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল ওপাশের পাহাড়ের আড়ালে। সে চিৎকার এমনই রক্ত জমানো যে, আঁতকে উঠে আরও ভালো করে চেপে বসলাম আসনে। চারপাশে আর একবার তাকাতে দেখি, কাছের যে জিনিসটাকে লালচে পাথরের চাঙড় বলে ভেবেছিলাম, আস্তে আস্তে সেটা এগিয়ে আসছে আমার দিকে। তখনই দেখলাম, পাথর নয়, দানব কাঁকড়ার মতো একটা প্রাণী গুঁড়ি মেরে এগচ্ছে আমার পানেই। কল্পনা করুন তো, দূরের ওই টেবিলটার মতো মস্ত বড় একটা কাঁকড়াকে, টলমল করছে তার অনেকগুলো পা, ধীরগতিতে এগিয়ে আসছে আপনার দিকে, বড় বড় দাঁড়া দুটো দুলছে, শংকর মাছের সুদীর্ঘ চাবুকের মতো লম্বা শুড়গুলো এদিকে-ওদিকে নড়ে নড়ে খুঁজছে শিকার, আর ধাতুর মতো কঠিন আর চকচকে আচ্ছাদনের দুপাশ থেকে বোঁটার ডগায় বড় বড় দুটো আগুন চোখ দপদপ জ্বলছে আপনার দিকে। পেছনদিকটা ঢেউতোলা অসমান, পাথরের গায়ে খোদাই করা কারুকাজের মতো হরেকরকম খাঁজকাটা। এখানে-সেখানে জমে রয়েছে সবুজ শেওলার স্তর। কিম্ভুতকিমাকার মুখের গর্তে যেন বিশ্বের খিদে নিয়ে মূর্তিমান বিভীষিকার মতো সে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসতে লাগল আমার পানে।
স্থাণুর মতো এই ভয়ংকর দানবটার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে রয়েছি, এমন সময়ে মাছি বসার মতো একটা সুড়সুড়ি লাগল আমার গালে। হাত দিয়ে ঝেড়ে দিলাম জায়গাটা, কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার সুড়সুড় করে উঠল গালটা, আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে কানের ওপরেও পেলাম সেই অনুভূতি। ঠাস করে চাপড় মারতেই সুতোর মতো কীসে হাত ঠেকল। তখুনি কিন্তু হাতের মধ্যে থেকে বেরিয়ে গেল জিনিসটা। দারুণ চমকে পেছন ফিরে দেখি, আর একটা অতিকায় কাঁকড়ার শুড়ের ডগা চেপে ধরেছিলাম আমি। আমার ঠিক পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল দানবটা। বোঁটার প্রান্তে নরকের আগুন জ্বলছিল লাল চোখে, ক্ষুধায় লোলুপ হয়ে উঠেছিল মুখের হাঁ, আর আঠালো কাদা-মাখা বড় বড় দাঁড়া বিরাট সাঁড়াশির মতো আস্তে আন্তে নেমে আসছিল আমার ওপর। চোখের পলক ফেলার আগেই লিভারের ওপর হাত দিয়ে এক মাসের ব্যবধান এনে ফেললাম আমার আর ওই দানোগুলের মধ্যে। মেশিন তখনও সেই একই বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে, কাজেই মূর্তিমান বিভীষিকাগুলোকে দেখতে পেলাম তখনও। প্রায় এক ডজন কাঁকড়া পানসে আলোয় সবুজ শেওলার মধ্যে এদিকে সেদিকে নড়াচড়া করছে।
সে যে কী ধু ধু শূন্যতা ছড়িয়ে ছিল পৃথিবীর আকাশে-বাতাসে, তা আপনাদের কিছুতেই বোঝাতে পারব না। পুবের লাল আকাশ, পশ্চিমের অন্ধকার, নোনা-ধরা সাগর, পাথরে সাগরতীরে ধীরগতি কুৎসিত দানবগুলো, গাছ-শেওলার একই রকম বিষ-সবুজ রং, ফুসফুস ফাটানো লঘু বাতাস, সবকিছুই নিঃসীম আতঙ্কে আচ্ছন্ন করে দেয় সমস্ত চেতনা। আরও একটা বছর এগিয়ে গেলাম আমি। কিন্তু সেখানেও সেই লাল সূর্য, আরও ম্যাড়মেড়ে। সেই মরা সাগর। সেই ঠান্ডা বাতাস। আর একই রকম কঠিন বর্ম-পরা প্রাণীদের সবুজ শেওলা আর লাল পাহাড়ের মধ্যে নড়াচড়া। আর দেখলাম, পশ্চিম আকাশে মস্ত বড় একাদশীর চাঁদের মতো বাঁকানো একটা পাণ্ডুর রেখা। কিন্তু পরিবর্তন নেই মৃত্যুকঠিন অবসন্ন শ্মশানস্তব্ধতার।
এইভাবে থেমে থেমে এক-এক লাফে হাজার বছর কি তারও বেশি পেরিয়ে এগিয়ে চললাম আমি। পৃথিবীর অন্তিম অবস্থা দেখতে লাগলাম নিজের চোখে। সভয়ে দেখলাম, পশ্চিম আকাশে ক্রমশ আরও বড়, আরও ফ্যাকাশে হয়ে উঠছে সূর্য। বুঝলাম, পৃথিবীর আয় ফুরিয়ে আসছে। অবশেষে, আজ থেকে তিন কোটি বছর পরে লাল গোলার মতো বিপুল সূর্য প্রায়-অন্ধকার আকাশের দশ ভাগের প্রায় এক ভাগ আবছা করে তুলল। আবার থামলাম আমি। কেননা অগণিত কাঁকড়ার দল দেখলাম অদৃশ্য হয়ে গেছে, গাছ-শেওলা জাতের সবুজ উদ্ভিদ ছাড়া লাল বেলাভূমিতে প্রাণের কোনও চিহ্ন নেই। তারপরেই এল সাদা আস্তরণ। ঠান্ডায় হি-হি করে কেঁপে উঠলাম আমি। সাদা তুষার তার চাদর বিছিয়ে দিতে লাগল হেথায়-সেথায়। কালো আকাশের তারার আলোয় ঝিকমিক করে উঠল তুষারখচিত উত্তর-পূর্বদিক। দেখলাম, ঢেউখেলানো বিস্তর পাহাড়ের লালচে সাদা চুড়ো। সমুদ্রের ধারে জমেছে বরফ, জলে ভেসে যাচ্ছে বরফের চাঁই। তখনও চিরকালের মতো অস্ত-যাওয়া সূর্যের আলোয় রক্তিম লবণ-সমুদ্র জমে যায়নি।