দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বেশ খুশি-খুশি মনে মেশিনটার গায়ে হাত বোলাচ্ছি এমন সময়ে যে ভয় করেছিলাম তা-ই হল। হঠাৎ ব্রোঞ্জের পাত দুটো সড়ত করে বেরিয়ে এসে ঘটাং করে বন্ধ করে দিলে বেদির প্রবেশপথ। নিকষকালো অন্ধকারে কিছুই আর দেখতে পেলাম না, ফাঁদে পড়লাম আমি। মর্লকদের তাহলে এই মতলবই ছিল। আমার কিন্তু বেজায় হাসি পেয়ে গেল ওই অন্ধকারেও।
ইতিমধ্যে গুনগুন ধ্বনির মতো হাসির শব্দ এগিয়ে আসছিল আমার দিকে। খুব শান্তভাবে দেশলাইয়ের একটা কাঠি ঘষলাম মেশিনের গায়ে। লিভারটা যথাস্থানে বসানোর সময়টুকু শুধু আমার দরকার, তারপরেই ভূতের মতো যাব মিলিয়ে। কিন্তু একটি ছোট্ট জিনিস আমি একেবারেই ভেবে দেখিনি। যে দেশলাইয়ের কাঠি বারবার বারুদে না ঘষলে জ্বলে না, এ হল সেই জাতীয় কাঠি।
বুঝতেই পারছেন, কীভাবে মুখের হাসি মিলাল আমার। ততক্ষণে আমার ওপর এসে পড়েছে পুঁচকে জানোয়ারগুলো। একজন আমাকে ছুঁতেই হাতের লিভার দিয়ে এক ঘা বসিয়ে দিয়ে কোনওমতে উঠে বসলাম মেশিনের আসনে। আর-একটা হাত এসে পড়ল আমার ওপর, তারপরেই আবার একটা। কিলবিলে সাপের মতো হাতগুলো চেপে বসতে না বসতেই সরু সরু আঙুল দিয়ে লিভারটা ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল ওরা– আর সমানে ঘুসি-লাথি চালিয়ে কোনওরকমে ওদের ঠেকিয়ে রেখে মেশিনের গায়ে লিভারের খাঁজটা হাত বুলিয়ে বুলিয়ে খুঁজতে লাগলাম। একজন তো আচমকা হাত থেকে কেড়েই নিল লিভারটা, তৎক্ষণাৎ মাথা দিয়ে এক দারুণ ঢু মেরে উদ্ধার করলাম সেটা। বেশ কিছুক্ষণ ঝটাপটি করার পর শেষে লিভারটা আটকে গেল খাঁজে, ঠেলেও দিলাম সামনের দিকে। স্যাঁতসেঁতে হাতগুলো পিছলে গেল আমার দেহ থেকে। নিকষ অন্ধকার গেল মিলিয়ে। আগে যেরকম বলেছি, ঠিক সেইরকম ধূসর আলো আর মৃদু গুনগুনানির মধ্যে এসে পড়লাম আবার।
১৪. আরও ভবিষ্যতে
১৪। আরও ভবিষ্যতে
সময়-পর্যটন যে কী অস্বস্তিকর, তা আপনাদের আগেও বলেছি আমি৷ তার ওপরে এবার আমি ভালো করে আসনে বসতেও পারিনি। পাশের দিকে হেলে পড়ে কোনওরকমে ঠেকেছিলাম আসনে। কতক্ষণ যে এভাবে আঁকড়েছিলাম মেশিনটা, সে খেয়াল ছিল না। দুলুনি আর ঝাঁকুনির মধ্যে কীভাবে এগিয়ে যাচ্ছি, সেসবও দেখার মতো অবস্থা আমার ছিল না। অনেকক্ষণ বাদে একটু সামলে উঠে ডায়ালগুলোর দিকে তাকাতেই চক্ষুস্থির হয়ে গেল। একটা ডায়ালে দেখা যায় শুধু একদিনের হিসেব, আর একটায় হাজার দিনের, তার পাশেরটায় লক্ষ লক্ষ দিনের, আর সব শেষেরটায় কোটি কোটি দিনের। বিপরীত দিকে যাওয়ার লিভারটা না টেনে আমি মেশিনটা শুধু চালিয়ে দিয়েছিলাম, এখন ডায়ালের দিকে তাকাতে দেখি, হাজারের কাঁটাটা ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটার মতো বেগে ঘরে চলেছে–আর আমি এগিয়ে চলেছি আরও ভবিষ্যতের গর্ভে।
যতই এগতে লাগলাম, চারপাশে দেখলাম এক আশ্চর্য পরিবর্তন। দপদপে ধোঁয়াটে কুয়াশা আরও গাঢ় হয়ে উঠল। তারপরে, প্রচণ্ড বেগে ছুটে চলা সত্ত্বেও মিটমিটে তারার মতো আবার দেখা গেল দিনরাতের দ্রুত পরিবর্তন। ধীরগতিতে গেলে এ পরিবর্তন দেখা যায়। কিন্তু এত নিদারুণ বেগে যাওয়া সত্ত্বেও দিনরাতের আসা-যাওয়া স্পষ্টতর হয়ে উঠল। দারুণ ঘাবড়ে গেলাম। দিবানিশার পরিবর্তন-গতি আরও কমে আসতে লাগল, সেই সঙ্গে কমে এল আকাশে সূর্যের আনাগোনা। শেষকালে মনে হল, পরিবর্তন আসছে কেবল একশো বছর অন্তর অন্তর। প্রথমে পৃথিবীর ওপর দেখা গেল পরিবর্তনহীন স্থির এক গোধূলি, মাঝে মাঝে শুধু কালো আকাশকে চমকে দিয়ে আর গোধূলিকে ঝলসে দিয়ে তিরবেগে উধাও হয়ে গেল কয়েকটা ধূমকেতু।
আলোর যে চওড়া ফালিটা অবস্থান নির্দেশ করছিল, অনেক আগেই তা অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। কেননা, আর অস্ত যাচ্ছিল না সূর্য, শুধু পশ্চিমদিক থেকে উঠে আবার নেমে যাচ্ছিল পশ্চিমেই। আর ক্রমশ লাল, আরও জ্বলন্ত হয়ে উঠছিল তার আকৃতি। চাঁদের সব চিহ্ন মিলিয়ে গেল। তারাগুলোর ঘুরপাকও ক্রমশ কমতে কমতে এসে ঠেকল মৃদু সঞ্চরমাণ কয়েকটা আলোর বিন্দুতে। অবশেষে দিক্রেখার ওপর মস্ত বড় গাঢ় লাল সূর্য নিথর হয়ে রইল দাঁড়িয়ে, দীপ্তিহীন উত্তাপে জ্বলতে লাগল আর বিশাল থালার মতো গোল আকৃতি, মাঝে মাঝে ক্ষণেকের জন্যে নিবেও যেতে লাগল। একবার কিছুক্ষণের জন্যে বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, কিন্তু দেখতে দেখতে আবার ফিরে এল সেই ম্যাড়মেড়ে লাল আভা। উদয় আর অস্তর ধীরগতি দেখে বুঝলাম, চাঁদ যেমন এ যুগে পৃথিবীর দিকে সমানে একদিক ফিরিয়ে আছে, ঠিক তেমনি পৃথিবীও সূর্যের দিকে একদিক ফিরিয়ে স্থির হয়ে গেল। গতবারের মতো মেশিন সমেত উলটে পড়াটা যাতে আর না হয়, তাই খুব আস্তে আস্তে গতি কমিয়ে আনতে লাগলাম। ঘুরন্ত কাঁটাগুলোর ঘুরপাক ধীরে ধীরে কমে আসতে লাগল, শেষে হাজারের কাঁটাটা নিশ্চল হয়ে গেল দাঁড়িয়ে। স্কেলের ওপর কুয়াশার মতো দিনের কাঁটাটা ঘুরছিল, তাকেও বেশ স্পষ্ট দেখা গেল। আরও আস্তে–জনশূন্য বালুকাবেলার আবছা রেখা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল।
খুব সাবধানে মেশিন থামিয়ে চারদিকে ভালো করে তাকালাম। আকাশ আর নীল নেই। উত্তর-পূর্বদিক কালির মতো কুচকুচে কালো; আঁধারের মধ্যে থেকে স্থির দ্যুতিতে জ্বলজ্বল করছিল ফ্যাকাশে সাদা তারাগুলো। মাথার ওপর ঘোর রক্তবর্ণ। তারা নেই একটিও। দক্ষিণ-পূর্বদিক টুকটুকে লাল আভায় জ্বলছে, সেদিকেই দিক্রেখায় অর্ধেক ঢাকা পড়ে নিশ্চল হয়ে রয়েছে সূর্যের বিশাল লাল দেহ। চারপাশে পাহাড়গুলো রুক্ষ লালচে রঙের। প্রাণের চিহ্নের মধ্যে দেখলাম, শুধু দক্ষিণ-পূর্বদিক ছেয়ে রয়েছে ঘন সবুজ উদ্ভিদে। একটানা গোধূলির মধ্যে বৃদ্ধি-পাওয়া গাছপালার ওপর যেমন উজ্জ্বল সবুজ রং দেখা যায়, এ রংও যেন সেইরকম। এ যুগে গুহার গাছ-শেওলা আর জঙ্গলের শৈবালের রঙের সঙ্গে সে রঙের মিল আছে অনেকটা।