এরপরেই দেখলাম সে যুগের সবচেয়ে বীভৎস দৃশ্য। আগুনের আভায় খোলা জমিটা দিনের মতো উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। ঠিক মাঝখানে ছোটখাটো একটা পাহাড়। চারপাশে শুকনো কাঁটাগাছ গজিয়েছে প্রচুর। ওদিক থেকে আগুনের আর-একটা শাখা এগিয়ে আসছে এদিকে, মধ্যে মধ্যে হলুদ জিব লিকলিক করে লাফিয়ে পড়ছে আমার পানে। অর্থাৎ আগুনের বেড়াজালে আটকা পড়েছিল খোলা জমিটুকু। পাহাড়ের গায়ে তিরিশ-চল্লিশ জন মর্লক জোর আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ায় হতভম্বের মতো এলোমেলোভাবে দৌড়াদৌড়ি করছিল। প্রথমে ওদের অন্ধ অবস্থা আমি বুঝিনি, তাই যতবারই ছুটে এসেছে আমার দিকে, ততবার বেধড়ক পিটিয়েছি ডান্ডা দিয়ে। একজন তো মারের চোটে মরেই গেল, জনা তিনেক হাত-পা-মাথা ভেঙে রইল পড়ে। কিছুক্ষণ পরে একজনকে হাতড়াতে হাতড়াতে আগুনের দিকে এগিয়ে যেতে দেখে বুঝলাম ওদের অসহায় অবস্থা। তাই রেহাই দিলাম সে যাত্রা।
তা সত্ত্বেও মাঝে মাঝে দু-একজন সটান এগিয়ে এল আমার দিকে, প্রতিবারই শিউরে উঠে কাটিয়ে যেতে হল আমায়। মাঝখানে আগুনের তেজ একটু কমে আসতে ভাবলাম, আবার বুঝি মর্লকগুলো দেখে ফেলেছে আমায়। আরও কয়েকটাকে যমালয়ে পাঠাবার জন্যে ডান্ডা তুললাম ওপরে, কিন্তু আবার লকলকে হয়ে উঠল লাল শিখা। ডান্ডা নামিয়ে এদিকে-সেদিকে পায়চারি করতে লাগলাম উইনার খোঁজে, কিন্তু ওর কোনও চিহ্নই দেখতে পেলাম না।
শেষে হতাশ হয়ে পাহাড়ের চূড়ায় বসে বসে আগুনের আভায় অন্ধ পিশাচগুলোর এলোমলো নড়াচড়া দেখতে লাগলাম। আগুনের ছোঁয়া লাগামাত্র অপার্থিব শব্দে ককিয়ে চিৎকার করে উঠছিল ওরা। দু-একজন অবশ্য ওপরেও উঠে এসেছিল হাতড়াতে হাতড়াতে, কঠিন কয়েকটা ঘুসি মেরে তাদের ধরাশায়ী করার লোভ আর সামলাতে পারিনি।
সমস্ত রাত দারুণ ঘুমে জুড়ে আসতে লাগল আমার চোখের পাতা। চেঁচিয়ে ছুটে ঘুমকে তাড়াতে হয়েছিল চোখ থেকে। উঠেছি, বসেছি, বেড়িয়েছি এদিকে-ওদিকে, আর ভগবানকে ডেকেছি যেন আজকের রাতের মতো ঘুম না আসে চোখে। তিনবার দেখলাম, যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠে কতকগুলো মর্লক ছুটে গেল আগুনের ভেতরে। অনেকক্ষণ পর একসময়ে আগুনের লাল আভা আর রাশি রাশি কালো ধোঁয়াকে ফিকে করে দিয়ে এল ভোরের শুভ্র সুন্দর আলো।
আবার খুঁজে দেখলাম উইনাকে, কিন্তু কোথাও কোনও চিহ্ন দেখতে পেলাম না। মর্লকরা। যে বেচারিকে জ্বলন্ত জঙ্গলের মধ্যে ফেলে পালিয়েছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ রইল না আমার। দারুণ ইচ্ছে হল, আরও কয়েকটা মর্লকের মাথা গুঁড়িয়ে দিয়ে আসি। কিন্তু তা করে তো আর উইনাকে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না ইলয়দের মধ্যে। পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চারদিকে তাকাতেই সবুজ পোর্সেলিনের প্রাসাদ দেখতে পেলাম। সাদা স্ফিংক্স কোনদিকে আছে, ঠিক করে নিয়ে হাঁটা দিলাম সেইদিকে। আগুন তখনও রয়েছে এখানে-সেখানে। পায়ের তলায় রাশি রাশি ছাই থেকে গুমে গুমে উঠছে ধোঁয়া, গাছগুলোও ভেতরে ভেতরে পুড়ে চলেছে–তাই ধোঁয়া ওঠার বিরাম নেই। ধোঁয়ায় চারদিক কুয়াশার মতো আবছা হয়ে উঠেছিল। অস্পষ্টভাবে দেখলাম, কয়েকটা কদাকার মর্লক গোঙাতে গোঙাতে ঘুরছে। এলোমেলোভাবে। এরই মাঝ দিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে চললাম আমি। পায়ে অবশ্য পুরু করে ঘাস বেঁধে নিয়েছিলাম, তবুও অনাহারে, অনিদ্রায়, অবসাদে আমার তখন এক পা-ও যাওয়ার ক্ষমতা ছিল না। চোখ জ্বালা করছিল নিষ্পাপ উইনার শোচনীয় পরিণতির কথা ভেবে। আমিই তাকে এনেছিলাম, কিন্তু ফিরিয়ে দিতে পারলাম না তার পরিজনদের মাঝে।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পকেটে হাতড়াতে আনন্দে আমার মন নেচে উঠল। চারটে দেশলাইয়ের কাঠি পেলাম পকেটে। মর্লকরা বাক্সটা বার করে নিলেও কোনওরকমে এ চারটে কাঠি থেকে গেছে পকেটের কোণে।…
১৩. সাদা স্ফিংক্সে-এর ফাঁদ
১৩। সাদা স্ফিংক্সে-এর ফাঁদ
সকাল আটটা-নটা নাগাদ হলদে ধাতুর আসনের কাছে পৌঁছালাম আমি। চারদিক রোদ্দুরে ভরে উঠেছিল। গভীর প্রশান্তিতে ছেয়ে ছিল দিগদিগন্ত। সে প্রশান্তি আমার মনের জ্বালাযন্ত্রণাও স্নিগ্ধ হাতে জুড়িয়ে দিলে। গত রাতের দুঃস্বপ্নের মতো বিভীষিকা মিলিয়ে গেল মন থেকে, নিদারুণ শ্রান্তিতে সেই কবোষ্ণ সকালে ঘুমিয়ে পড়লাম আমি ঘাসজমির ওপর।
ঘুম যখন ভাঙল, সূর্য ডুবতে তখন আর বেশি দেরি নেই। আড়মোড়া ভেঙে তাড়াতাড়ি নেমে এলাম নিচে সাদা স্ফিংক্স-এর দিকে। এক হাতে পকেটে দেশলাই কাঠি নাড়াচাড়া করতে করতে অপর হাতে লোহার ডান্ডা বাগিয়ে ধরে নির্ভয়ে এগিয়ে গেলাম বেদির সামনে।
আর তারপরেই যা দেখলাম, তা আশা করিনি মোটেই। স্ফিংক্স-এর বেদির সামনে গিয়ে দেখি ব্রোঞ্জের দরজা খোলা, মজবুত পাতগুলো সরে গেছে পাশের খাঁজে।
দেখেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম–ঢোকা কি উচিত হবে?
ছোট্ট একটা কামরা দেখলাম ভেতরে, এক কোণে উঁচু জায়গার ওপর রয়েছে টাইম মেশিনটা। ছোট লিভারটা পকেটেই ছিল। ভাবলাম সাদা স্ফিংক্স আক্রমণের এত তোড়জোড় তাহলে সবই বৃথা, শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করল ওরা! লোহার ডান্ডা ছুঁড়ে ফেলে দিলাম। কাজে লাগল না বলে দুঃখ যে হল না তা নয়।
ভেতরে ঢোকার মুখে আবার থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। কোনও বদ মতলব নেই তো হতভাগাদের? কিন্তু পরক্ষণেই দমকা হাসি চেপে ব্রোঞ্জ ফ্রেম পেরিয়ে সিধে এগিয়ে গেলাম টাইম মেশিনের কাছে। অবাক হয়ে দেখলাম, তেল-টেল দিয়ে বেশ পরিষ্কার করে রাখা হয়েছে মেশিনটা। ওরা হয়তো যন্ত্রটার রহস্য বোঝার জন্যে কতকগুলো অংশ খুলেও ফেলেছিল, না পেরে আগের মতোই ভ্রু এঁটে রেখে দিয়েছিল এক কোণে।