তৎক্ষণাৎ বুঝলাম, এ ছাপ মর্লকদের পায়ের ছাপ হয়ে যায় না। বুঝলাম, যন্ত্রপাতি নিয়ে মাথা ঘামাতে গিয়ে এতটা সময় নষ্ট করা কোনওমতেই উচিত হয়নি আমার। বিকেল গড়িয়ে এল। অথচ তখনও পর্যন্ত আত্মরক্ষার জন্যে কোনও হাতিয়ার, কোনও আশ্রয়, এমনকী আগুন জ্বালাবার কোনও বন্দোবস্তও করে উঠতে পারিনি। তারপরেই গ্যালারির নিচে দূর অন্ধকারের মধ্যে থেকে ভেসে এল অদ্ভুত রকমের খসখস শব্দ–যে শব্দ আমি শুনেছি কুয়োর নিচে।
হঠাৎ মাথায় একটা মতলব এল। পাশের মেশিনটা থেকে লিভারের মতো একটা লোহার ডান্ডা বেরিয়ে ছিল। মেশিনটার ওপর উঠে দুহাতে লিভারটা আঁকড়ে ধরে সব শক্তি দিয়ে চাপ মারলাম পাশের দিকে। মিনিটখানেক জোর দেওয়ার পর খসে এল লিভারটা। দেখলাম মর্লকদের পাতলা খুলি ফাটানোর পক্ষে ওই ডান্ডাই যথেষ্ট। সেই মুহূর্তে দারুণ ইচ্ছে হল, নিচে নেমে গিয়ে কতকগুলো খুলি চুরমার করে আসি। কিন্তু পাছে শেষ পর্যন্ত টাইম মেশিনটা হারাতে হয়, এই ভয়ে এগলাম না। ভাবছেন নিজের বংশধরদের খুন করার এত পাশব ইচ্ছে কেন? আরে মশাই, সে কদর্য জীবগুলোকে দেখলে আপনারও ওই একই ইচ্ছে হত৷
এক হাতে উইনা আর এক হাতে লোহার ডান্ডা নিয়ে উঠে এলাম ওপরে, ঢুকলাম পাশের আরও বড় একটা হলে। দেখে মনে হল যেন সামরিক গির্জায় ঢুকে পড়েছি। ফালি ফালি ছেঁড়া জীর্ণ নিশান ঝুলছে এদিকে-সেদিকে। বইয়ের মতো কতকগুলো জিনিস দেখলাম, যদিও বই বলে আর চেনা যায় না তাদের। বোর্ড আর চিড়-খাওয়া ধাতুর মলাট দেখেই বুঝলাম, একসময়ে প্রচুর বই স্থান পেয়েছিল এই ঘরে।
তারপর একটা চওড়া সিঁড়ি বেয়ে এলাম যে ঘরে, একসময়ে বোধহয় শিল্প বিষয়ক বিভাগ ছিল সেখানে। ঘরের একদিকের ছাদ ধসে পড়লেও বাকি অংশে প্রতিটি জিনিস সাজানো ছিল পরিষ্কারভাবে। ব্যস্তসমস্ত হয়ে ইতিউতি দেখতে দেখতে যা চাইছিলাম, তা পেলাম। এক কোণে বায়ুনিরোধক একটা দেশলাইয়ের বাক্স। দুরুদুরু বুকে ঘষলাম একটা কাঠি, ফস করে জ্বলে উঠল কাঠিটা। যাক, তাহলে ভিজে ওঠেনি কাঠিগুলো। মহানন্দে ইচ্ছে হল, দুহাত তুলে নাচি। কিন্তু এ বয়সে নাচা শোভা পায় না, তাই গলা ছেয়ে The Land of the Leal গাইলাম বেশ কিছুক্ষণ ধরে। বীভৎস প্রাণীগুলোকে জব্দ করার একটা জুতসই হাতিয়ার পেয়ে আমার আনন্দ যেন আর বাধা মানতে চাইল না।
স্মরণাতীত বছরের পরও একেবারে তাজা অবস্থায় দেশলাই পাওয়া যে কতটা সৌভাগ্যের ফলে সম্ভব, সেই কথাই ভাবতে ভাবতে আর-একটা জিনিস দেখে মনটা আবার নেচে উঠল। ভেবেছিলাম জিনিসটা কয়েক টুকরো মোম। ইচ্ছে ছিল বাতি বানানো যাবে, তাই মুখবন্ধ কাচের জারটা ভেঙে ফেললাম। কিন্তু যা পেলাম, তা মোম নয়। গন্ধ থেকে বুঝলাম কর্পূরের টুকরো। হতাশ হয়ে ফেলে দিতে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ মনে পড়ল কর্পূর তো দাহ্য পদার্থ। জ্বালিয়ে দিলে বাতির মতো চমৎকার আলো দেবে। সুতরাং পকেটে চালান করে দিলাম টুকরোগুলো। কিন্তু স্ফিংক্স-এর দরজা ওড়ানোর জন্যে কোনও বিস্ফোরক পেলাম না। লোহার ডান্ডা দিয়ে সে কাজ সারব, এই মতলব আঁটতে আঁটতে মহানন্দে বেরিয়ে এলাম ঘর ছেড়ে।
সে দীর্ঘ অপরাহের খুঁটিনাটি বর্ণনা শোনানোর মতো জোরালো স্মৃতিশক্তি আমার নেই। পরপর সাজিয়ে সব বলাও সম্ভব নয়। মনে আছে, মরচে-পড়া অস্ত্রের একটা লম্বা গ্যালারিতে ঢুকেছিলাম। লোহার ডান্ডা ফেলে দিয়ে কুড়ল নিই কি তলোয়ার নিই, এই দোটানায় পড়লাম সেখানে। দুটোই তো আর বয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। শেষকালে ভেবে দেখলাম ব্রোঞ্জের দরজার পক্ষে লোহার ডান্ডাই আদর্শ হাতিয়ার, তা-ই মনস্থির করে তলোয়ার ফেলে রেখে গেলাম অন্যদিকে। দেখলাম প্রচুর বন্দুক, পিস্তল আর রাইফেল। বেশির ভাগ অস্ত্রেই মরচে ছাড়া আর কোনও পদার্থ নেই। কতকগুলো এক ধরনের নতুনরকম ধাতুতে তৈরি মনে হল। সেগুলো অবশ্য মোটামুটি চলনসই অবস্থায় ছিল। কিন্তু কার্ট্রিজ আর গান-পাউডার যা ছিল, তা অনেকদিন আগেই নষ্ট হয়ে মিশে গেছে ধুলোয়। আর একদিকে দেখি সারি সারি দেবমূর্তি সাজানোপলিনেশিয়ান, মেক্সিকান, গ্রিসিয়ান, ফোনিশিয়ান–কোনও দেশই বাদ যায়নি। কী খেয়াল হল, দক্ষিণ আমেরিকার একটা বিদঘুটে দানোর নাকের ওপর লিখে রাখলাম আমার নাম।
যতই বিকেল গড়িয়ে আসতে লাগল, ততই কমতে লাগল আমার আগ্রহ। ধূলিধূসর নিথর পুরীর একটার পর একটা গ্যালারি পেরিয়ে চললাম আমি। কোনওটায় শুধু ভাঙা পাথর আর মরচে-পড়া ধাতুর রাশি, কোনওটায় ছড়ানো দুষ্প্রাপ্য সামগ্রী। আচমকা চোখে পড়ল টিন-খনির একটা মডেল, তারপরেই হঠাৎ দেখলাম এয়ার-টাইট কৌটোয় পাশাপাশি সাজানো দুটো ডিনামাইট কাটিজ! ইউরেকা বলে চেঁচিয়ে উঠলাম সোল্লাসে। দারুণ আনন্দে তখুনি চুরমার করে ফেললাম কৌটোটা। কিন্তু তার পরেই কীরকম সন্দেহ হল। একটু ইতস্তত করে গ্যালারির কোণে কার্ডিজ রেখে আগুন দিলাম সলতেতে। এমন নিরাশ আর কখনও হইনি আমি। পাঁচ-দশ-পনেরো মিনিট অপেক্ষা করলাম, কিন্তু বিস্ফোরণ আর হল না। বুঝলাম ও দুটো নিছক ডামি ছাড়া আর কিছু না।
তারপরেই প্রাসাদের মধ্যে ছোট্ট একটা প্রাঙ্গণে এসে পড়লাম আমরা। বেশ পরিষ্কার ঘাসজমির ওপর দেখলাম তিনটে ফলের গাছ। খিদে পেয়েছিল খুব। কাজেই ফলাহারের পর ঘাসের ওপর একটু জিরিয়ে নিলাম। নিরাপদ আশ্রয়স্থান তখনও মেলেনি অথচ রাত এল ঘনিয়ে। মনে মনে ভাবলাম, আর দরকারও হবে না। মর্লকদের দূরে ঠেকিয়ে রাখার পক্ষে এক বাক্স দেশলাই যথেষ্ট। ঠিক করলাম, বাইরে আগুনের কুণ্ড জ্বালিয়ে আজ রাতটা কাটিয়ে কাল সকালেই লোহার ডান্ডা দিয়ে ভাঙব ব্রোঞ্জের দরজা
১২. অন্ধকারে
১২। অন্ধকারে