হেসে ওঠেন সময়-পর্যটক–সত্যিই কি তা-ই? স্থানের তিন মাত্রার মধ্যে আমাদের গতিবিধি কি একেবারেই অবাধ? ডাইনে, বামে, সামনে, পেছনে গেলাম–অর্থাৎ শুধু দুটো মাত্রার ভেতরে ইচ্ছামতো চলাফেরা করলাম, কিন্তু ওপরে-নিচে আসা-যাওয়া কি সম্ভব? মাধ্যাকর্ষণ তো বাধা দিচ্ছে সেদিকে।
দিলেই বা? বেলুন তো রয়েছে সে-বাধা কাটাবার জন্য।
কিন্তু বেলুন আবিষ্কারের আগে ওপরে-নিচে খাড়াইভাবে চলাফেরা করার কোনও পন্থাই মানুষের জানা ছিল না।
কিন্তু লাফঝাঁপ দিয়ে ওপর-নিচে সামান্য নড়াচড়াও তো করা যেত?
ওপরে ওঠার চাইতে নিচে নামাটা ছিল আরও সহজ।
আরে মশাই, সময়ের মধ্যে তো আপনি তা-ও পারছেন না। বর্তমান মুহূর্ত থেকে দূরে চলে যাওয়ার কোনও ক্ষমতাই নেই আপনার।
ভুল করলেন মশায়, ভুল করলেন ওইখানেই। সারা দুনিয়া ভুল করছে ঠিক ওই জায়গাটিতে। বর্তমান মুহূর্ত থেকে আমরা নিয়তই দূরে সরে যাচ্ছি। দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত একটা নিরবচ্ছিন্ন সমান গতিতে আমাদের নির্মাত্রা, নির্বস্তু মানসিক স্থায়িত্ব সময় মাত্রার ওপর দিয়ে এগিয়ে চলেছে–অনন্তকাল ধরে প্রবহমান এই অবিরাম গতির মধ্যে নেই যতির আয়েশ, অনিয়মের দিকহীনতা অথবা স্ব-ইচ্ছার শ্লথতা। পৃথিবীর পঞ্চাশ মাইল ওপরে ছেড়ে দিলে আমরা যেমন শুধু নিচের দিকেই নামতে থাকতাম–ঠিক তেমনি জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত কালপথে আমাদের যাত্রাও রয়েছে অব্যাহত।
কিন্তু অসুবিধেটা কী জানেন, বাধা দিয়ে বললেন মনোবিজ্ঞানী, স্থানের তিন মাত্রার মধ্যে আপনি যেদিকে খুশি বেড়াতে পারেন কিন্তু সময়ের মধ্যে তো আপনি তা-ও পারছেন না।
আমার আবিষ্কারের মূল উৎস তো সেইখানেই। ধরুন, অতীতের কোনও একটা ঘটনা চিন্তা করছেন আপনি। তৎক্ষণাৎ আপনার মন উধাও হয়ে যাচ্ছে পুরানো দিনের মাঝে। কিন্তু ইচ্ছেমতো আপনার মনকে আপনি সেখানে ধরে রাখতে পারছেন না। যেমন, মাটি থেকে ছ-ফুট লাফিয়ে উঠেও কোনও বর্বরই পারে না ছ-ফুট উঁচুতে নিজেকে ধরে রাখতে। কিন্তু সভ্য মানুষের মাথা বর্বর মানুষের চেয়েও অনেক উন্নত। তাই বেলুন আবিষ্কার করে তারা যদি মাধ্যাকর্ষণ শক্তিকে হারাতে পারে, তবে নতুন কিছু একটা আবিষ্কার করে সময়-মাত্রার মধ্যে পেছিয়ে যাওয়া অথবা যেদিকে ইচ্ছা যাওয়ার ক্ষমতাই বা তারা পাবে না কেন বলুন?
অসম্ভব। শক্ত গলায় বলে ফিল্বি।
কেন অসম্ভব? শুধান সময়-পর্যটক।
যুক্তি দিয়ে সাদাকে কালো প্রমাণ করতে পারেন, কিন্তু আমার মনে বিশ্বাস তো আর গেঁথে দিতে পারেন না।
তা অবশ্য ঠিক। আচ্ছা, এখন শুনুন, চার-মাত্রার জ্যামিতি নিয়ে গবেষণা করার পেছনে আমার আসল উদ্দেশ্যটা কী। অনেকদিন আগে আমার মাথায় একটা মেশিনের পরিকল্পনা আসে–
সময়ের মধ্যে ঘুরে বেড়ানোর জন্যে! উদ্গত বিস্ময় আর চাপতে পারে না পাশের ছেলেটি।
চালকের ইচ্ছামতো স্থান আর সময়ের মধ্যে যেদিকে খুশি, যেভাবে খুশি, যতক্ষণ খুশি ঘুরে বেড়াবে সেই মেশিন।
খুকখুক করে হেসে ওঠে ফিল্বি।
যতসব গাঁজাখুরি থিয়োরি! মুখের ওপর বলে দেন মনোবিজ্ঞানী।
আমার কাছেও এটা একদিন থিয়োরি ছিল–ছিল অলীক অবাস্তব এক কল্পনা। এবং এ থিয়োরি আপনাদের সামনে কোনওদিনই হাজির করতাম না, যদি না–
এক্সপেরিমেন্ট! আর চুপ করে বসে থাকতে পারি না আমি। আপনি এবার হাতেনাতে আপনার ওই উদ্ভট থিয়োরি প্রমাণ করতে শুরু করবেন নাকি?
এক্সপেরিমেন্ট! গোল গোল হয়ে ওঠে ফিল্বির চোখ।
দেখাই যাক-না থিয়োরির মধ্যে গাঁজার পরিমাণটা কত! শ্লেষভরে বলেন মনোবিজ্ঞানী। সামান্য একটু হাসলেন সময়-পর্যটক। তারপর ঠোঁটের কোণে হাসিটুকু নিয়ে প্যান্টের দু-পকেটে হাত ভরে এগিয়ে গেলেন বারান্দা দিয়ে ওপাশে। একটু পরেই ফিরে এলেন তিনি।
০২. মেশিন
২। মেশিন
চকচকে ধাতুর তৈরি একটা যন্ত্র দেখলাম সময়-পর্যটকের হাতে। টাইমপিসের চেয়ে সামান্য বড় যন্ত্রটা, কিন্তু নিখুঁতভাবে তৈরি। হাতির দাঁত আর কয়েকটা স্বচ্ছ ক্রিস্টালের কারুকাজও দেখলাম তার মাঝে। যন্ত্রটার বিচিত্র গঠন দেখে কৌতূহল না জেগে পারে না।
এরপরে যা ঘটল তা সত্যই অবর্ণনীয়। আটকোনা একটি টেবিল এনে রাখা হল আগুনের সামনে। ওপরে মেশিনটাকে বসিয়ে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সামনে বসলেন ভদ্রলোক। মেশিন ছাড়াও টেবিলের ওপর ছিল একটা শেড-দেওয়া ল্যাম্প-চিকমিক করছিল মডেলটা তার আলোয়। ঘরের মধ্যে এদিকে-সেদিকে আরও প্রায় ডজনখানেক মোমবাতি থাকায় আলোর অভাব ছিল না মোটেই। আগুনের একেবারে কাছেই বসেছিলাম আমি। সময়-পর্যটকের পেছনে বসল ফিল্বি। বাঁদিকে বসলেন ডাক্তার আর প্রাদেশিক মেয়র –ডানদিকে মনোবিজ্ঞানী, অল্পবয়েসি ছেলেটা রইল আমার ঠিক পেছনেই। প্রত্যেকেই চোখ-কান খুলে বেশ সজাগ হয়ে বসে–কাজেই এরকম পরিস্থিতিতে হাতসাফাই যে একেবারেই অসম্ভব, তা বুঝলাম সবাই।
আমাদের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন সময়-পর্যটক। তারপর টেবিলের ওপর কনুই রেখে দু-হাতের তালুতে আলতোভাবে ধরলেন মেশিনটাকে।
বললেন, ছোট্ট একটা মডেল–আর কিছু না। সময়ের মাঝে খেয়ালখুশিমতো ঘুরে বেড়ানোর অভিনব এক পরিকল্পনা। মেশিনটার নিখুঁত কারুকাজ, এদিকের এই সূক্ষ্ম রডটা, ওপাশের ওই লিভার–প্রতিটিই লক্ষ করার মতো, মনে রাখার মতো। খুবই খুদে এই মেশিন। কিন্তু একেই তৈরি করতে আমার পুরো দুটি বছর গেছে। লিভারটা টিপলে মেশিন উধাও হয়ে যাবে ভবিষ্যতের গর্ভে আর এটা টিপলে যাবে ঠিক উলটোদিকে– অতীতের হারানো পাতায়। এই আসনটা হল চালকের বসবার জায়গা। ভালো করে দেখে রাখুন মডেলটা–টেবিলের ওপর নজর রাখুন সবাই। পরে যেন বলে বসবেন না যে, ধাপ্পাবাজের মতো হাতসাফাইয়ের ভেলকি দেখিয়ে বোকা বানিয়েছি সবাইকে।