প্রাসাদ পরীক্ষা করে দেখলাম বাস্তবিকই তা আগাগোড়া পোর্সেলিনে তৈরি। সামনের দিকে বিচিত্র হরফে এককালে কিছু লেখা ছিল, কিন্তু তা পড়া সম্ভব হল না আমার পক্ষে। দরজার পেল্লায় পাল্লাগুলো অনেক আগেই খসে পড়েছিল কবজা থেকে। কাজেই ভেতরে ঢুকতে কোনও অসুবিধা হল না। সামনেই দেখলাম মস্ত লম্বা একটা গ্যালারি, দুপাশের সারি সারি জানলা দিয়ে আলো আসছে ভেতরে। দেখেই মনে হল, এ মিউজিয়াম না হয়ে যায় না। টালি দিয়ে বাঁধানো মেঝেতে পুরু হয়ে জমেছে ধুলো, ওপরে ধুলোর চাদরে ঢাকা-পড়া এদিকে-সেদিকে ছড়ানো কত আশ্চর্য আর অদ্ভুত জিনিস। হলের ঠিক মাঝখানে অতিকায় একটা কঙ্কালের নিচের অংশ পড়ে থাকতে দেখলাম। বাঁকা পা দেখে বুঝলাম কঙ্কালটা মেগাথিরিয়াম জাতীয় কোনও অধুনালুপ্ত প্রাণীর। পুরু ধুলোর মাঝে মাথার খুলি আর ওপরের হাড়গুলো পড়ে ছিল। পাশের খানিকটা অংশ ছাদ থেকে বৃষ্টির জল পড়ে অনেকদিন আগেই ক্ষয়ে ধুলোয় মিশে গেছে। গ্যালারিতে ব্রন্টোসরাসের একটা বিপুল কঙ্কালও দেখলাম। আমার অনুমান তাহলে মিথ্যে নয়, এটা মিউজিয়ামই বটে। পাশের ঢালু তাকগুলোর ধুলো ঝেড়ে পেলাম আমাদের যুগের পরিচিত কাচের আলমারি। ভেতরের জিনিসগুলোর অম্লান অবস্থা দেখে বুঝলাম প্রত্যেকটি আলমারি নিশ্চয় এয়ার-টাইট করা।
বুঝতেই পারছেন, আগামীকালের সাউথ কেন্সিংটনের এক ভাঙা স্তূপের মাঝে স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম, নিশ্চয় এককালে পৃথিবীর জীববিজ্ঞান বিভাগ ছিল সেখানে। কত রকমারি জীবাণু যে দেখলাম, তার ইয়ত্তা নেই। জীবাণু আর ছত্রাক লোপ পাওয়ার ফলে যদিও ক্ষয়ের প্রকোপ শতকরা নিরানব্বই ভাগ কমে গিয়েছিল; তবুও মূল্যবান বহু জীবাণু ধংসের হাত থেকে রেহাই পায়নি। এখানে-সেখানে খুদে মানুষের প্রায়-নষ্ট বহু জীবাণু দেখলাম ধুলোয় মলিন হয়ে উঠেছে। কোথাও টুকরো টুকরো হয়ে ঝুলছে তাকের ওপর। কতকগুলো আলমারির তো কোনও চিহ্নই পেলাম না, বোধহয় মর্লকরা সরিয়েছে সেগুলো। চুঁচ পড়ার শব্দ শোনা যায় এমনি গভীর নৈঃশব্দ্য চেপে বসেছে চারদিকে। পুরু ধুলোয় পা বসে যাচ্ছিল আমাদের। উইনা একটা সামুদ্রিক শজারু নিয়ে খেলা করছিল, আমায় চুপ করে দাঁড়াতে দেখে দৌড়ে এসে হাত ধরে দাঁড়াল পাশে।
এই একটা হলের আকার দেখে মনে হল, সবুজ পোর্সেলিনের প্রাসাদে শুধু আদিম জীববিজ্ঞানের গ্যালারিই নেই, ঐতিহাসিক গ্যালারি, এমনকী গ্রন্থাগার থাকাও অস্বাভাবিক নয়। গত যুগের মানুষদের বিপুল প্রতিভার এই বিরাট নিদর্শন দেখে স্তম্ভিত না হয়ে পারলাম না। আর-একটু এগতে প্রথম গ্যালারির সঙ্গে আড়াআড়িভাবে আর-একটা ছোট গ্যালারি দেখলাম। এখানে দেখলাম রাশি রাশি খনিজ পদার্থ। হঠাৎ এক টুকরো গন্ধক দেখে ভাবলাম, গান-পাউডার তৈরি করলে কেমন হয়? তা-ই দিয়ে সাদা স্ফিংক্স-এর ব্রোঞ্জের দরজা উড়িয়ে টাইম মেশিন উদ্ধার করা তো নিতান্ত ছেলেখেলা। কিন্তু শোরা পেলাম না কোথাও। নাইট্রেট জাতীয় কোনও কেমিক্যালসই পেলাম না। বলা বাহুল্য, অনেক বছর আগে সেসব উবে মিলিয়ে গেছে বাতাসে। গন্ধকটা কিন্তু তবুও হাতছাড়া করতে মন চাইল না। গ্যালারির মধ্যে আর বিশেষ কিছু দেখার ছিল না। বিশেষ করে খনিজ পদার্থের মাথামুন্ডু যখন আমি বুঝি না, তখন এ হল থেকে বেরিয়ে আর-একটা ভাঙাচোরা হলে প্রবেশ করলাম। এককালে বোধহয় জীববিদ্যার বিভাগ ছিল এখানে– যদিও কিছু আর চেনার উপায় ছিল না তখন। জীবজন্তুর কতকগুলো ধুলো-পড়া টুকরো টুকরো মূর্তি, জারে রাখা শুকনো মমি–জারের স্পিরিট অবশ্য অনেক আগেই উবে গিয়েছিল; দুষ্প্রাপ্য গাছপালার বাদামি একটু ধুলো; বাস, আর কিছু নেই। মানুষ জাতটা কীভাবে দুভাগ হয়ে মর্লক আর ইলয়ে এসে ঠেকেছে, তা দেখতে পেলাম না বলে খুব হতাশ হলাম। এরপর ঢুকলাম একটা মস্ত বড় গ্যালারিতে। একে তো হলটা বড়, তার ওপর আলো কমে আসায় দুপাশের দেওয়ালও দেখা যাচ্ছিল না ভালো করে। ঘরের মেঝে ঢালু হয়ে নেমে গেছে নিচের দিকে। দুরে দুরে অবশ্য ছাদ থেকে বড় বড় সাদা কাচের গ্লোব ঝুলছিল, যদিও বেশির ভাগই আর আস্ত ছিল না। কাচের ফানুস দেখেই বুঝলাম, একসময়ে কৃত্রিম আলোর ব্যবস্থা ছিল জায়গাটায়। দুপাশে মস্ত উঁচু উঁচু মেশিনের সারি চলেছে, এক-একটা মেশিন যে কত বড় তা আপনাদের বলে বোঝাতে পারব না। সব মেশিনেই মরচে ধরেছে, কতকগুলো ভেঙেচুরে গেছে। জানেন তো, যন্ত্রপাতির ওপরে আমার একটু দুর্বলতা আছে, তাই তন্ময় হয়ে গেলাম মেশিনগুলোর মধ্যে। কিন্তু বুঝলাম না কী কাজে লাগত এত মেশিন।
হঠাৎ গা ঘেঁষে দাঁড়াল উইনা। চমকে উঠেছিলাম আমি। আর তখনই লক্ষ করলাম, গ্যালারির মেঝে তখনও ঢালু হয়ে নেমে চলেছে নিচের দিকে। যেদিক দিয়ে এসেছি, সেদিকটা দেখলাম বেশ খানিকটা উঁচুতে। সরু সরু জানলা দিয়ে আলো ঝরে পড়ছে সেখানে। কিন্তু পথটা যতই ঢালু হয়ে নেমেছে নিচের দিকে, ততই কমেছে জানলার সংখ্যা আর আলোর পরিমাণ। মেশিনগুলোর জটিলতা তখনও আমার মাথায় ঘুরছে, আনমনা হয়ে চলতে চলতে আলো যে আস্তে আস্তে কমে এসেছে তা লক্ষ করিনি। কিন্তু উইনার ভয় ক্রমাগত বেড়েই চলেছে দেখে মেশিনের চিন্তা ছেড়ে ভালো করে তাকালাম সামনের দিকে। দেখলাম, গ্যালারি আরও খানিকটা নেমে নিঃসীম অন্ধকারের মাঝে হারিয়ে গেছে। থমকে গিয়ে চারপাশে তাকাতেই দেখি, আগের চাইতে ধুলো অনেক কমে এসেছে, মেঝেও আর ততটা মসৃণ নয়। আরও সামনে অন্ধকারের দিকে ছোট ছোট কতকগুলো পায়ের ছাপ দেখতে পেলাম।