দেশলাইয়ের কাঠি যে মাত্র চারটিতে এসে ঠেকেছে, তা শেষবার কাঠি জ্বালতে গিয়েই দেখেছিলাম। ইলয়দের নিয়ে মজা করার জন্যে দেদার কাঠি জ্বালাতাম আমি–তখন বুঝিনি, ওই সামান্য কাঠিই এত কাজে লাগতে পারে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে ভাবছি, আর কাঠি অপচয় করা উচিত হবে কি না, এমন সময়ে একটা হাত এসে পড়ল আমার হাতে, তারপরেই সরু আঙুলের ছোঁয়া লাগল আমার মুখে, আর কীরকম বোটকা একটা গন্ধ ভেসে এল নাকে। চারপাশে ভয়াবহ জীবগুলোর শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনলাম, বহুজনে ঘিরে ধরেছে আমাকে। অনুভব করলাম, খুব সন্তর্পণে দেশলাইয়ের বাক্সটা আমার হাত থেকে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করছে কয়েকজন, আর কয়েকটা হাত টানাটানি করছে আমার পোশাক। সারা দেহে এদের ছোঁয়া অনুভব করে আমি এত অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম যে বলার নয়। আচম্বিতে ভাবলাম, এরা কেন এভাবে পরীক্ষা করছে আমায়? কী চায় ওরা? কী ওদের মতলব? ভয়ে শিউরে উঠলাম। হঠাৎ বিকট হুংকার দিয়ে উঠলাম। চমকে পিছিয়ে গেল ওরা, তারপরেই শুনলাম, আবার এগিয়ে আসছে। এবার আরও জোরে চেপে ধরল আমায়, আর অদ্ভুত ফিসফিস স্বরে কথা বলতে লাগল নিজেদের মধ্যে। সর্বাঙ্গ কেপে উঠল আমার। আবার বিকট শব্দে চেঁচিয়ে উঠলাম। এবার কিন্তু ওরা আর ভয় পেল না, বরং রক্ত হিম করা হাসির শব্দ ভেসে এল আমার কানে। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। কোনওরকমে একটা কাঠি বার করে জ্বালালাম। তারপর পকেট থেকে এক টুকরো কাগজ বার করে দেশলাইয়ের শিখায় তা জ্বালিয়ে নিয়ে পিছু হটে যেতে লাগলাম সুড়ঙ্গের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু একটু যেতে-না-যেতেই নিবে গেল আগুন, অন্ধকারের মধ্যে শুনলাম, খসখস শব্দে মর্লকরা দৌড়ে আসছে আমার দিকে।
মুহূর্তের মধ্যে কতকগুলো হাত আঁকড়ে ধরল আমায়। ওরা যে আমাকে ভেতরে টেনে নিয়ে যেতে চায়, সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ রইল না। আর-একটা কাঠি জ্বালিয়ে ওদের মুখের ওপর নেড়ে চোখ ধাঁধিয়ে দিলাম। ওদের চেহারা যে কী কদাকার আর অমানুষিক, তা আপনারা কল্পনা করতে পারবেন না। রক্তহীন, চিবুকহীন মুখ আর বড় বড় গোলাকার লালাভ ধূসর দুই চোখ। চোখের পাতা না থাকায় আলোর জেল্লায় ওরা প্রায় অন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সেই সুযোগে ওদের ভালো করে দেখে আমার গা বমি-বমি করে উঠল। বেশি দেরি করলাম না, ওই অবস্থাতেই পিছু হটে চললাম। দ্বিতীয় কাঠি ফুরাতে জ্বালোম তৃতীয় কাঠি। এটা ফুরাতে ফুরাতেই পৌঁছালাম সুড়ঙ্গের মুখে। কুয়োর নিচে বিরাট পাম্পের গুরুগম্ভীর শব্দে মাথা ঘুরে যাওয়ায় কিনারায় শুয়ে পড়লাম আমি। তারপরেই পাশে হাত বাড়ালাম হুকগুলোর দিকে। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে ওরা আমার দুপা ধরে দারুণ হ্যাঁচকা টান মারলে পেছনে। শেষ কাঠিটা জ্বালোম আমি… কিন্তু তখুনি নিবে গেল কাঠিটা। ততক্ষণে আমার হাত গিয়ে পড়েছে মইয়ের ওপর। কাজেই প্রচণ্ড কয়েকটা লাথিতে মকদের ছিটকে ফেলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব উঠতে লাগলাম ওপরে। ওদের মধ্যে একজন অবশ্য কিছু দূর পর্যন্ত উঠে আমার বুটটা ধরেছিল, কিন্তু পদাঘাত ছাড়া তার বরাতে সেদিন আর কিছুই জোটেনি।
ওপরে ওঠা যেন আর ফুরাতেই চায় না। শেষ বিশ-তিরিশ ফুট ওঠার সময়ে দারুণ গা গুলিয়ে উঠল আমার। অতিকষ্টে আঁকড়ে রইলাম হুকগুলো। জ্ঞান হারানোর মতো অবস্থা হল শেষ কয়েক গজ ওঠার সময়ে, প্রাণপণে নিজেকে সামলে রাখলাম। কয়েকবার তো মাথা ঘুরে গেল। একবার মনে হল, পড়ে যাচ্ছি। শেষকালে কোনওরকমে উঠে এলাম কুয়োর মুখের কাছে, টলতে টলতে বেরিয়ে এলাম রোদ্দুরভরা ভাঙা স্কুপের মাঝে। উপুড় হয়ে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। মাটির গন্ধ যে কত মিষ্টি, তা বুঝেছিলাম সেদিন। তারপর কানে ভেসে এল উইনা আর কজন ইলয়ের মিষ্টি স্বর। এরপরেই জ্ঞান হারালাম কিছুক্ষণের জন্যে।
১০. রাত্রে
১০। রাত্রে
আরও শোচনীয় হয়ে উঠল আমার অবস্থা। এতদিন শুধু ভেবেছি, কী করে ফিরে পাওয়া যায় টাইম মেশিন। কিন্তু মর্লকদের আস্তানা আবিষ্কার করার পর থেকে নতুন একটা দুশ্চিন্তা দেখা দিল। সে দুশ্চিন্তা অমাবস্যার অন্ধকারকে নিয়ে।
অবাক হচ্ছেন আপনারা। ভাবছেন, অমাবস্যার অন্ধকারকে এত ডরানোর কী আছে। কিন্তু উইনাই এ দুশ্চিন্তা ঢোকালে আমার মাথায়। অবোধ্য শব্দ আর দুর্বোধ্য ভাবভঙ্গি দিয়ে সে বুঝিয়ে দিলে রাতের অন্ধকারের বিভীষিকা। প্রতিরাতে অন্ধকারের অন্তরকাল একটু একটু করে বেড়েই চলেছে, এগিয়ে আসছে অমাবস্যা। সেই প্রথম উপলব্ধি করলাম, অন্ধকারকে কেন ইলয়রা এত ভয় পায়। না জানি অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে মর্লকরা কী নরকলীলা চালায় মাটির ওপর। আমার দ্বিতীয় অনুমান যে একেবারে ভুল, সে বিষয়ে আরও কোনও সন্দেহ ছিল না। বহুকাল আগে ইলয়রা ছিল মর্লকদের প্রভু। কিন্তু বহু বছর নিশ্চিন্ত জীবনযাপনের ফলে ইলয়রা কারলোভিগনিয়ান রাজাদের মতো আরও সুন্দর হয়ে উঠলেও একেবারে অপদার্থ বনে গেছে। আর মর্লকরা হয়ে দাঁড়িয়েছে তাদের প্রভু। বহুকাল মাটির নিচে থাকার ফলে ওপরের আলো-হাওয়া মোটেই সহ্য হয় না মকদের, তাই ইলয়দের তারা ওপরেই থাকতে দিয়েছে। বহুদিনের মজ্জাগত অভ্যাসের ফলে ইলয়দের পোশাক ইত্যাদির জোগান দিলেও মনিব-চাকরের পুরানো সম্পর্ক আর নেই। বহুকাল আগে মানুষ তার যে ভাইকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিল মাটির নিচে–সেই ভাই ফিরে এসেছে অন্য রূপ ধরে। ভয় কী বস্তু, তা ইলয়রা জেনেছিল অনেক আগেই। ধীরে ধীরে আবার নতুন করে এই ভয়ের আস্বাদ তারা পেতে শুরু করেছে। নিচের টেবিলের ওপর রাখা মাংসের দৃশ্যটা চোখের সামনে ভেসে উঠল। হাড়ের আকারটা একটু চেনা মনে হলেও বুঝলাম না ঠিক কোন প্রাণীর।