হাঁটতে হাঁটতে এই সব কথাই ভাবছিলাম। এদের অর্থনৈতিক সমস্যার যে প্রশ্নটি আমাকে রীতিমতো ভাবিয়ে তুলেছিল, তার সমাধানও পেলাম তখন।
মানুষের এই প্রজাতি যে পাতালবাসী সে বিষয়ে আর দ্বিমত নেই। তিনটি বিশেষ অবস্থা দেখে বুঝলাম কদাচিৎ জমির ওপর আসার কারণ ওদের বহুকাল ধরে মাটির নিচে বসবাসের অভ্যাস। প্রথমেই দেখুন না কেন, যে সব জন্তু বেশিরভাগ সময় অন্ধকারে থাকে, তাদের গায়ের রং ফ্যাকাশে সাদা। কেনটাকি গুহার সাদা মাছের কথা তো জানেনই। তারপর ওদের বড় বড় চোখে আলোর প্রতিফলন যা শুধু নিশাচর প্রাণীদের চোখেই দেখা যায়। উদাহরণ–পেঁচা আর বেড়াল। সব শেষে দেখুন, সূর্যের আলোয় ওর চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়া অবস্থাটা। আলো থাকা সত্ত্বেও মাথা নিচু করে ছুটে গিয়ে পাথরে ধাক্কা লাগা আর তার পরেই অন্ধকারের মাঝে আশ্রয় নেওয়ার প্রচেষ্টা–এ সব দেখলে শুধু একটি সিদ্ধান্তেই আসা যায়, তা হল ওদের রেটিনা অর্থাৎ চোখের পর্দা যেমন পাতলা, তেমনি দারুণ অনুভূতিশীল।
আমার পায়ের নিচে পৃথিবীর বুক অসংখ্য সুড়ঙ্গে ঝাঁঝরা হয়ে রয়েছে। নতুন জাতির নিবাস এই সুড়ঙ্গেই। বাতাস চলাচলের জন্য কুয়ো আর থামের আধিক্য থেকেই অনুমান করা যায় কী সুদূরব্যাপী তাদের বসতি। আর তাই যদি হয়, তাহলে দিনের আলোয় মাটির ওপর যে জাতি বাস করছে, সুখ-সুবিধা চাহিদার জন্যে নিচের জগতের বাসিন্দারা যে তৎপর নয় তাই বা কে নিশ্চয় করে বলতে পারে? এই যুক্তিসঙ্গত চিন্তাধারা থেকে মানব জাতির দুভাগ হয়ে যাওয়া সম্বন্ধে যে থিয়োরী খাড়া ধরলাম, তা শুনুন।
আমাদের বর্তমান যুগের সমস্যা থেকেই এগনো যাক। মালিক এবং শ্রমিক গোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমশ বেড়ে যাওয়া সামাজিক ব্যবধানই রয়েছে সবকিছুর মূলে। ভাবছেন বুঝি আমার মাথা খারাপ হয়েছে। কিন্তু আজকের যুগেই কি সে যুগের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছেন না? লন্ডনে মাটির তলায় মেট্রোপলিটন রেলওয়ে, ইলেকট্রিক রেলওয়ে, সাবওয়ে, মাটির তলায় কারখানা, রেস্তোঁরা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় একদিন পৌঁচেছে, যেদিন মাটির ওপর সব অধিকার হারিয়ে মাটির নিচে আশ্রয় নিয়েছে। সমস্ত শিল্প। বছরের পর বছর ফ্যাক্টরীর সংখ্যা বেড়ে গেছে মাটির নিচে, শ্রমিকরা দিনরাতের বেশিরভাগ সময় কাটাতে বাধ্য হয়েছে পাতালের অন্ধকারে। শেষে একদিন…! এমন কি আজও ইস্ট এণ্ডের শ্রমিকরা ইচ্ছেমতো পৃথিবীর ওপর আসার সুযোগ পায় কি?
গরীবদের কাছ থেকে দূরে সরে যাওয়ার প্রচেষ্টা সবযুগের ধনীদের মধ্যেই আছে। অর্থ, শিক্ষা, সামাজিক প্রতিষ্ঠা–এই সবকিছুই ধনীদের ঠেলে দিয়েছে পৃথিবীর সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য আলো-হাওয়ার মধ্যে। আর তারাই গরীবদের বাধ্য করেছে মাটির নিচে থেকে কলকজা চালাতে। হাজার হাজার বছর ওই অবস্থায় থাকতে থাকতে অন্ধকারেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। তারা। যেমন অভ্যস্ত হয়েছে ঊধ্বজগতের মালিকরা আলো-হাওয়ার মধ্যে।
প্রতিভার চরম শিখরে উঠে আদর্শ সমাজ ব্যবস্থার প্রচলন করতে পেরেছিল মানবজাতি। শিক্ষা, সভ্যতা, জ্ঞান, প্রতিভার সে সোনার যুগ কিন্তু একদিন ফুরলো। অত্যন্ত সুষ্ঠু নিরাপত্তার মধ্যে দীর্ঘকাল নিশ্চিন্ত অলস জীবনযাপন করার ফলে উধ্বজগতের বাসিন্দাদের ধীশক্তি, দৈহিক শক্তির সঙ্গে দেহের আকারও কমে আসতে লাগল আস্তে আস্তে। কিন্তু মর্লকরা (পাতালবাসীদের ওই নামেই ডাকত সবাই) মানুষদের বৈশিষ্ট্য কিছু কিছু তখনও বজায় রেখে দিলে নিজেদের মধ্যে। কিন্তু একটা প্রশ্নের সদুত্তর পেলাম না কিছুতেই। টাইম মেশিন কি মর্লকরা নিয়েছে? তাই যদি নেয়, আর ইলয়রা (ফুটফুটে মানুষদের নাম যে ইলয়, তা উইনার কাছে জেনেছিলাম পরে) যদি ওদের প্রভু হয়, তবে মেশিনটা কেন ওরা ফিরিয়ে আনছে না মর্শকদের কাছ থেকে? অন্ধকারকেই বা এত ভয় করে কেন ওরা? এ প্রশ্নের উত্তর তখন না পেলেও পরে পেয়েছিলাম।
০৯. মর্লক
৯। মর্লক
দুদিন পর আমার নতুন-পাওয়া সূত্র ধরে কাজ শুরু করলাম। স্যাঁতসেঁতে জীবগুলো দেখলেই কেমন জানি গা শির শির করে উঠত আমার। মিউজিয়ামের স্পিরিটে-ডোবানো ম্যাটমেটে সাদা রঙের পোকামাকড়ের মতো দেখতে ওগুলোকে। চুলেও গা ঘিন ঘিন করে। আমার এই গা ঘিঘিনে ভাবটা খুব সম্ভব ইলয়দের কাছ থেকে পেয়েছিলাম। ফুটফুটে জাতটার ওপর আমার বেশ সহানুভূতি এসে গিয়েছিল। তা ছাড়া ওরা যে মর্লকদের মোটেই পছন্দ করে না, তা একটু একটু করে পরে বুঝেছিলাম।
পরের রাতে ভালো করে ঘুমোতে পারলাম না। শরীরটাও ভালো যাচ্ছিল না। উদ্বেগ আর সংশয়ে বেশ দমে গিয়েছিলাম। বেজায় ভয় পেয়ে বার দুয়েক শিউরে উঠলাম, কী কারণে তা অবশ্য বুঝিনি। রাত হয়ে যেতে নিঃশব্দে হলঘরে এসে ঢুকলাম আমি। খুদে মানুষরা দল বেঁধে ঘুমাচ্ছিল টুকরো টুকরো চাঁদের আলোয় গা এলিয়ে দিয়ে। বুঝলাম, আর দিনকয়েকের মধ্যে অমাবস্যার পথে আরও গড়িয়ে যাবে চাঁদ, আঁধারও একটু একটু করে বাড়তে থাকবে। আর নিচের জগতের কৃমিকীটের মতো জঘন্য সাদা লিমারগুলো পালে পালে উঠে আসবে ওপরে। টাইম মেশিন উদ্ধার করতে হলে যে আগে নিচুতলার রহস্য সমাধান করা দরকার, তা আমি হাড়ে হাড়ে বুঝেছিলাম। কিন্তু একলা এগবার মতো দুঃসাহস আমার ছিল না। একজন সঙ্গীও যদি পেতাম, কাউকে ডরাতাম না। কুয়োর অন্ধকারে তাকালেই গা ছমছম করে উঠত আমার।