সেদিন বোধহয় চতুর্থ দিন। সকালবেলা চারদিক বেশ গরম হয়ে উঠেছে। বড় বাড়িটির কাছে বিশাল ভগ্নস্তূপটার আনাচে-কানাচে গরম আর রোদ্দুরের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে একটা আশ্রয় খুঁজছিলাম। এই পটাতেই তখন আমি খাওয়া-দাওয়া সেরে ঘুমোতাম। এমন সময়ে অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটল। ভাঙা চোরা ইমারতের একটা স্কুপে ওঠার পর সঙ্কীর্ণ একটা গ্যালারি দেখতে পেলাম, পাশের জানলাগুলো ধ্বসে পড়া পাথরের চাঁইয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। বাইয়ের চোখ ধাঁধানো আলো থেকে হঠাৎ ভেতরে তাকিয়ে নিকষ অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেলাম না। হাতড়াতে হাতড়াতে ঢুকলাম ভেতরে, চোখের সামনে তখনও লাল আঁকাবাঁকা রেখা ছাড়া আর কিছু দেখছি না। আচম্বিতে মন্ত্রমুগ্ধের মতো থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। অন্ধকারের ভেতরে থেকে এক জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে–বাইরের দিনের আলোর প্রতিফলনে জ্বলজ্বল করছে সে চোখ।
আমি বর্তমান যুগের মানুষ, তাই প্রথমেই বুনো জানোয়ারের সম্ভাবনা মনে এল। শক্ত করে মুঠি পাকিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম সামনের জ্বলন্ত গোলাকার চোখ দুটোর দিকে। পিছু ফেরার মতো সাহসও ছিল না আমার। কিন্তু তারপরেই ভাবলাম, এখানকার মানুষ তো বেশ নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা মধ্যে বাস করে–তবে…! হঠাৎ মনে পড়ল অন্ধকারকে কী রকম যমের মতো ভয় করে এরা। সাহস একটু ফিরে এসেছিল, তাই সামনের দিকে। এক পা এগিয়ে কথা বললাম আমি। ভয়ের চোটে গলার স্বর অবশ্য রীতিমতো কর্কশ আর বেসুরো শোনাল। সামনে হাত বাড়াতে একটা নরম জিনিসের ছোঁয়া পেলাম। তৎক্ষণাৎ চোখ দুটো সরে গেল পাশের দিকে, আর সাঁৎ করে সাদা মতো একটা কিছু পাশ দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল পেছন দিকে! বলতে লজ্জা নেই, সঙ্গে সঙ্গে হৃৎত্যন্ত্রটা ধড়াস করে একটা ডিগবাজী খেয়ে এসে ঠেকল গলার কাছে–চট করে পেছন ফিরে দেখলাম আমার পেছনে রোদ-ঝলমলে পথের ওপর দিয়ে মাথা নিচু করে অদ্ভুত ভঙ্গিতে ছুটে যাচ্ছে কিম্ভুতকিমাকার মর্কটের মতো একটা জানোয়ার। গ্রানাইটের একটা চাঁইতে ধাক্কা খেয়ে একদিকে ছিটকে পড়ল জানোয়ারটা, পরমুহূর্তেই উঠে পড়ে মিলিয়ে গেল পাশের ভাঙা পাথরের স্তূপের অন্ধকারে।
জানোয়ারটাকে অবশ্য খুব খুঁটিয়ে দেখার সময় পাইনি, কিন্তু যতদূর দেখেছি গায়ের রং তার ম্যাড়মেড়ে সাদা, ধূসর-লালাভ বড় বড় অদ্ভুত আকারের দুটো চোখ, আর মাথায় পিঠে শণের মতো চুলের রাশি। এত দ্রুতবেগে অন্ধকারের মাঝে সে সেঁধিয়ে গেল যে এর বেশি কিছু দেখার সুযোগ পেলাম না। আদতে সে চার হাত-পায়ে ভর দিয়ে দৌড়োচ্ছিল, কি সামনে দুহাতে ভর দিয়ে নিচু হয়েছিল, তা-ও দেখিনি। মুহূর্তের জন্য স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে ভাঙা স্যুপটার মধ্যে ঢুকে পড়লাম আমি। প্রথমে কিছুই দেখলাম না। বেশ কিছুক্ষণ হাতড়াবার পর দেখি হুবহু সেই রকম কুয়োর মতো একটা গর্ত, আড়াআড়িভাবে ওপরটা ঢেকে রেখেছে একটা ভাঙা থাম। চকিতে ভাবলাম বিদঘুটে জানোয়ারটা কি তাহলে এর মধ্যেই লুকিয়েছে? ফস করে জ্বালোম একটা কাঠি–নিচের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার ওপর বড় বড় জ্বলন্ত চোখের অপলক দৃষ্টি রেখে দ্রুতবেগে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে ছোটখাট সাদা একটা প্রাণী। ঠিক যেন একটা মানুষ মাকড়শা! কি বেয়ে জন্তুটা অত তাড়াতাড়ি নামছে দেখতে গিয়ে সেই প্রথম দেখলাম ধাতুর তৈরি হাত-পা রাখার একসারি খোঁটা মইয়ের মতো সিধে নেমে গেছে নিচে। তারপরেই কাঠিটা আঙুল পর্যন্ত পুড়ে নিবে গেল, তাড়াতাড়ি জ্বালালাম আর একটি কাঠি। কিন্তু খুদে দানোটা ততক্ষণে অদৃশ্য হয়ে গেছে নিচের অন্ধকারে।
কুয়োর অন্ধকারে তাকিয়ে কতক্ষণ যে সেখানে বসেছিলাম জানি না; যাকে এইমাত্র দেখলাম, সে যে একজাতীয় মানুষ, এ ধারণায় কিছুতেই আমার মন সায় দিতে চাইল না। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ ভাবার পর সত্যের মুখ দেখলাম। বুঝলাম, মানুষ আর একটিমাত্র প্রজাতি (species) নয়–দু শ্রেণীর প্রাণীতে ভাগ হয়ে গেছে তারা। ঊর্ধ্ব জগতের ফুটফুটে মানুষরাই আমাদের একমাত্র বংশধর নয়; চোখের সামনে দিয়ে বিদ্যুতের মতো এই যে ম্যাটমেটে সাদা কুৎসিত নিশাচর জানোয়ারটা পালিয়ে গেল এরাও আমাদের রক্ত বহন করছে তাদের শিরায়।
গোলগম্বুজের গায়ে চারকোণা থামের ওপর বাতাসের থির থির কাঁপন, কুয়ো আর সুষ্ঠু বাতাস চলাচলের পদ্ধতির চিন্তা মনে এল আমার। এই বিরাট আয়োজনের উদ্ভব কোথায়, তা যেন একটু একটু করে দানা বেঁধে উঠতে লাগল আমার মনে। সামঞ্জস্যময়। এই অপূর্ব শৃঙ্খলার সঙ্গে লিমারগুলোর কী সম্পর্ক তারও কিছুটা আঁচ পেলাম, কিন্তু বুঝলাম না, কুয়োর নিচে কী লুকানো আছে। বুঝলাম না, কেন অহরহ যন্ত্রপাতি চলার শব্দ ভেসে আসে ওপরে। ভাবছি একবার নিচে নেমে নিজের চোখে দেখে আসতে হবে সেখানকার রহস্য, এমন সময়ে দুজন খুদে মানুষকে দেখলাম বাইরের আলোয়। ওরা কিন্তু কুয়োর পাড়ে ওই ভাবে আমাকে বসে থাকতে দেখে বেশ ঘাবড়ে গেল। ওদের ডেকে এনে কুয়োর নিচে আঙুল দেখিয়ে ইঙ্গিতে প্রশ্ন করলাম। কিন্তু উত্তর দেওয়া দূরে থাক, কী রকম ভয় ভয় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে দুজনেই ছুট লাগালে অন্য দিকে। বাধ্য হয়ে উঠতে হল আমাকে। ঠিক করলাম উইনাকে জিজ্ঞেস করতে হবে কুয়োর রহস্য।