স্বয়ংচালিত সভ্যতা আর ক্ষয়িষ্ণু মানবজাতি সম্বন্ধে আমার থিয়োরী যে বেশিদিন তেঁকেনি, তা আমি স্বীকার করছি। কিন্তু এ ছাড়া কী আর ভাবা যায় বলুন? যতগুলো বিরাট প্রাসাদে আমি গেছি, সবগুলোতেই শুধু খাবার আর শোবার জায়গা ছাড়া আর কিছু দেখিনি৷ কোনওরকম যন্ত্রপাতির চিহ্নও চোখে পড়েনি। কিন্তু খুদে মানুষদের ঝলমলে পোশাকগুলোও তো মাঝে মাঝে পালটানো দরকার। ওদের অদ্ভুত ডিজাইনের স্যাণ্ডেলগুলো এক রকম ধাতুর তৈরি, সেগুলোই বা আসে কোত্থেকে? অথচ সৃষ্টির স্পৃহা যে ওদের মধ্যে নেই, তা মুখ-চোখ দেখলেই বোঝা যায়। দোকান নেই, আমদানীরও চিহ্ন নেই। সারাদিন শুধু মহাখুশীতে খেলাধুলো করে, নদীতে স্নান করে, ফল খেয়ে, ফুল ছুঁড়ে, রাত্রে দল বেঁধে ঘুমোনোই তাদের কাজ। কিন্তু কীভাবে যে সব চলছে, তা বুঝিনি।
আট লক্ষ দুহাজার সাতশো এক সালের জগতে পৌঁছানোর পর তৃতীয় দিন কিন্তু আমি একজন সাথী পেলাম। অল্প জলে কয়েকজন খুদে মানুষ স্নান করছিল। বসে বসে দেখছিলাম আমি। হঠাৎ ওদের একজন স্রোতের টানে ভেসে গেল একটু দূরে। টান অবশ্য বেশি ছিল না, কিন্তু তবুও কেউ সাহস করলে না বেচারাকে বাঁচাবার। এ থেকেই বুঝে নিন কি রকম দুর্বল তারা। চোখের সামনে চীৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে একজন ডুবে যাচ্ছে দেখে আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম জলে। অল্প চেষ্টাতেই তাকে তুলে আনলাম তীরে। ফুটফুটে ছোট্ট একটি মেয়ে। হাত-পা একটু ঘষতেই চাঙা হয়ে উঠল সে৷ এর পর থেকেই কিন্তু আমার সঙ্গিনী হয়ে উঠল মেয়েটি। সব সময়ে ছায়ার মতো লেগে থাকত আমার পাছু পাছু। আমিও একজন সাথী পেয়ে খুশী হলাম। একটু চেষ্টা করে নামটাও শুনলাম– উইনা। আমার এই ছোট্ট সাথীটির সঙ্গ কিন্তু দিন সাতেকের বেশি পাইনি–সেকথা পরে বলছি!
উইনার কাছ থেকেই আমি প্রথম জানলাম যে, ভয় এখনও এ জগৎ ছেড়ে যায়নি। দিনের আলোয় দিব্বি হেসে-খেলে বেড়াত সে, কিন্তু আলো ফুরোনোর সঙ্গে সঙ্গে উইনার সাহস-ও ফুরোত। দেখেছি অন্ধকারকে, ছায়াকে আর যত কিছু কালো বস্তুকে ভয় করত সে। শুধু সে-ই নয়। রাত হলেই খুদে মানুষরা বড় বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়ে দল বেঁধে ঘুমোতে৷ আলো না নিয়ে তখন তাদের মাঝে যাওয়া মানে নিদারুণ ভয় পাইয়ে দেওয়া। আমি তো অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর কাউকেই ঘরের বাইরে একলা ঘুরতে বা ঘরের ভেতরে একলা ঘুমোতে দেখিনি।
সেদিন ভোরের দিকে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল। দুঃস্বপ্ন দেখছিলাম। মনে হচ্ছিল যেন ডুবে যাচ্ছি আমি আর সমুদ্রের কুৎসিত প্রাণীগুলো তাদের থলথলে ভিজে শুঁড় বোলাচ্ছে আমার মুখে। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম, আর কেন জানি মনে হল ধূসর রঙের কোনও জানোয়ার এইমাত্র ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল বাইরে। অদ্ভুত শিরশিরে সে অনুভূতি, বোঝানো যায় না কিছুতেই। আবার ঘুমোবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু এত অস্বস্তি বোধ করতে লাগলাম যে, ঘুমোনো আর সম্ভব হল না। আলোছায়ার মায়াময় পরিবেশে রহস্যময় হয়ে উঠেছিল চারিদিক অন্ধকারের বুক চিরে আলোর নিশানা দেখা দিলেও তখনও সবকিছু যেন বর্ণহীন অপ্রাকৃত কুহেলী-ভরা। উঠে পড়লাম। বিরাট হলটা পেরিয়ে প্রাসাদের বাইরের উঠোনে দাঁড়ালাম। ইচ্ছে হল ব্রাহ্মমুহূর্তে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যতের সূর্যোদয় দেখব।
চাঁদ তখন অস্তের পথে। চাঁদের মরা আলো আর ভোরের স্বচ্ছ কিরণ মিশে গিয়ে ফ্যাকাশে আধো আলোর সৃষ্টি হয়েছিল। ঝোঁপঝাড়গুলো তখন কালির মতো কালো, জমি ধোঁয়াটে কুয়াশায় ঢাকা, আকাশ বিরং, বিষণ্ণ। ঠিক এমনি মুহূর্তে মনে হল যেন দূরে পাহাড়ের ওপর ভৌতিক মূর্তি দেখতে পেলাম আমি। ঢালু জমির ওপর চোখ বুলোতে গিয়ে বেশ কয়েকবার চোখে পড়ল অস্পষ্ট কতকগুলো চেহারা। বার দুয়েক মনে হল বাঁদরের মতো একটা সাদা জন্তু পাহাড়ের ওপর বেগে দৌড়ে গেল। আর একবার মনে হল তাদেরই কয়েকজন কালো মতো একটা দেহ বয়ে নিয়ে যাচ্ছে ধ্বংসস্তূপের দিকে। খুব দ্রুত নড়াচড়া করছিল ওরা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে কোথায় গেল, তা আর দেখতে পেলাম না–যেন ঝোপঝাড়ের সঙ্গে মিলিয়ে গেল সবাই। তখনও চারিদিক অস্পষ্ট। ঠান্ডায় হোক বা যে কারণেই হোক, গা-টা বেশ শিরশির করে উঠল। দুই চোখ মুছে ভালো করে তাকালাম আমি।
পূর্বদিক ফরশা হয়ে উঠল আস্তে আস্তে। চারিদিক বেশ পরিষ্কার হয়ে উঠতে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি মেলে তাকালাম পাহাড়ের দিকে। সাদা মূর্তির কোনও চিহ্নই দেখলাম না। অন্ধকারের প্রাণী ওরা, তাই যেন আধধা আলোর মধ্যে মিলিয়ে গেল অপছায়ার মতো। আমার কিন্তু মনে হল টাইম-মেশিন খুঁজতে গিয়ে যে সাদা রঙের জানোয়ারটাকে আমি চমকে দিয়েছিলাম, তার সঙ্গে এদের নিশ্চয় কোনও সম্পর্ক আছে।
স্বর্ণযুগের আবহাওয়া যে এ যুগের চাইতে কত বেশি গরম তা আমি আগেই বলেছি। এর কারণ ঠিক করে বলা কঠিন। সুর্য আরও বেশি গরম হওয়ার জন্যেও হতে পারে। অথবা সূর্যের আরও কাছে পৃথিবীর সরে যাওয়ার ফলেও হতে পারে। কিন্তু কনিষ্ঠ ডারউইনের ভবিষ্যদ্বাণী সম্বন্ধে যারা ওয়াকিবহাল নয়, তারা ভুলে যায় যে সূর্য থেকে যেসব গ্রহের জন্ম, তাদের প্রত্যেকেই একে একে আবার ফিরে যাবে সূর্যে। আর যতবার ঘটবে এ ঘটনা, ততবারই নতুন তেজে দপ করে জ্বলে উঠবে সূর্য। হয়তো কাছাকাছি থাকা কোনও গ্রহ এই ভাবেই আশ্রয় নিয়েছে সূর্যের আগুন-জঠরে। কারণ যাই হোক না কেন, সূর্যের কিরণ যে এখনকার চাইতে অনেক বেশি জ্বালা ধরানো, সে বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নেই।