কিন্তু এত সহজে দমে যাবার পাত্র আমি নই। দমাদম শব্দে ব্রোঞ্জের পাতের ওপর ঘুষি মারতে শুরু করলাম। মনে হল, একটা কিছু নড়াচড়ার শব্দ শুনলাম ভেতরে। কে যেন খুক। খুক করে হেসে উঠল। আমার ভুলও হতে পারে। নদীর ধার থেকে বড়সড় আকারের একটা পাথর তুলে এনে সমস্ত শক্তি দিয়ে মারতে লাগলাম সামনের পাতটার ওপর, কিছু কিছু অলংকরণ নষ্ট হয়ে পাতটা খানিকটা তুবড়ে গেল, কিছু ব্রোঞ্জের গুড়োও ঝরে পড়ল। কিন্তু তবুও অটল অনড় রইল সে দুর্ভেদ্য বেদী। দমদম শব্দ শুনে ফুটফুটে মানুষগুলো দূরে দূরে ভীড় করে দাঁড়িয়েছিল, চোখে তাদের অদ্ভুত দৃষ্টি। শেষকালে ক্লান্ত অবসন্ন হয়ে বসে পড়লাম আমি।
কিন্তু একনাগাড়ে কাঁহাতক আর বেদীটাকে চোখে চোখে রাখা যায়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজে ডুবে থাকা খুবই সহজ আমার পক্ষে। কিন্তু নির্মা হয়ে বসে থাকার মতো কষ্টকর আর কিছু নেই। তাই এক সময়ে উঠে পড়ে এলোমেলোভাবে হাঁটতে শুরু করলাম। মনে মনে বললাম, ধৈর্য ধর। মেশিন যে-ই নিক না কেন, বেদীর ওপর দারুণ শব্দ শুনেই সে বুঝেছে, মেশিন নেওয়ায় তুমি খুশী হওনি। কাজেই হয়তো একদিন আপনি ফেরত দিয়ে যাবে। ইতিমধ্যে জড়ভরৎ হয়ে বসে না থেকে দেখে নাও, প্রবীণ জগতের সবকিছু দুচোখ ভরে দেখে নাও।
তাই দেখতে বেরোলাম আমি। বিজ্ঞানী সুলভ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে সবকিছুই তন্ন তন্ন করে দেখলাম আর বিচার করলাম। তারপর একসময়ে ঢুকলাম বড় প্রাসাদটায়। লক্ষ্য করলাম খুদে মানুষগুলো যেন আমাকে এড়িয়ে থাকতে চায়। বোধ হয় ব্রোঞ্জের বেদী তুবড়ে দেওয়ার প্রতিক্রিয়া দেখে আমিও বিশেষ মেলামেশা করার চেষ্টা করলাম না। দিন দুয়েকের মধ্যে অবশ্য সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল। আমিও ভাষা শেখার চেষ্টায় খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ভাষা শেখার পেছনে আমার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল। তা হল ব্রোঞ্জের বেদীর মধ্যে টাইম মেশিন সেঁধেনোর ব্যাপারটা তাদের মগজে, তাদেরই ভাষার সাহায্যে ঢোকানোর চেষ্টা। মেশিন উদ্ধার আমাকে করতেই হবে। সেজন্যে কোনও কিছুই করতে কসুর করলাম না আমি।
০৮. ব্যাখ্যা
৮। ব্যাখ্যা
যতদূর চোখ যায়, দেখি টেম্স উপত্যকার মতোই অকৃপণ প্রাচুর্যে ভরে উঠেছে ধরিত্রীর বুক। প্রতিটি পাহাড়ের ওপর থেকে দেখলাম সেই একই দৃশ্য–প্রাসাদের পর প্রাসাদ, বিচিত্র তাদের গঠন কৌশল, জমকালো তাদের আকার। এক একটা বাড়ি এক এক রকম সৌন্দর্যে ঝলমল করছে। চারিদিক সবুজে সবুজ, এসেছে চিরবসন্ত, এনেছে শধ কড়ি, ফল আর ফল। এখানে সেখানে রুপোর মতো করুক করছে জলের রেখা। আর দূরে একটু একটু করে উঁচু হয়ে গিয়ে নীল পাহাড়ের তরঙ্গে মিশেছে সবুজ জমি, তারপর মিলিয়ে গেছে নিমল নীলাকাশের বুকে। কতকগুলো অদ্ভুত জিনিস কিন্তু চোখে পড়ার মতো। গোলাকার কূয়োর মতো কতকগুলো গভীর গর্ত–বিস্তর ছড়িয়ে আছে এদিকে সেদিকে। পাহাড়ে ওঠার সময়ে একটা দেখেছিলাম পথের ধারে। সবগুলোই ব্রোঞ্জে বাঁধানো, বিচিত্র কারুকাজ করা। বৃষ্টির জলরোধের জন্যে, ওপরে গুমটির মতো গোলগম্বুজ। এই সব কুয়োয় পাশে বসে নীচের কুচকুচ্ অন্ধকারের মধ্যে তাকালে জলের রেখা মোটেই দেখা যায় না, দেশলাইয়ের আলোর প্রতিফলন ফিরে আসে না ওপরে। প্রত্যেকটির মধ্যে শুনেছি বিশেষ একটি শব্দ ধুম্ ধুম ধুম্। বিরাট ইঞ্জিন অবিরাম ঘরে চললে এ জাতীয় শব্দ শোনা যায়। দেশলাইয়ের শিখার কাঁপন থেকে যা আবিষ্কার করলাম, তা আরও আশ্চর্য। দেখলাম, বাতাসের স্রোত বিরামবিহীনভাবে নেমে যাচ্ছে কুয়োগুলির মধ্যে। কাগজের ছোট্ট একটা কুচি ছেড়ে দিলাম কুয়োর মুখে। ধীরে ধীরে ভাসতে ভাসতে নিচের দিকে না নেমে বাতাসের টানে সাঁৎ করে দৃষ্টির আড়ালে নেমে গেল কুচিটা।
এরপর ঢালু জমির এখানে-সেখানে দাঁড়ানো ছুঁচোলো থামগুলোর সঙ্গে কুয়োগুলোর একটা সম্পর্ক বার করে ফেললাম। দারুণ গরমের দিনে রোদে জ্বলা বালুকা বেলার ওপর যেমন বাতাসের অস্থির কাঁপন দেখা যায়, ঠিক তেমনি থিরথিরে কাঁপন দেখেছিলাম প্রতিটি থামের শীর্ষবিন্দুতে। এ সব থেকেই মাটির তলায় বাতাস চলাচলের একটা বিরাট পরিকল্পনা আঁচ করেছিলাম। কিন্তু আমার ধারণা যে কিছুটা ভুল, তা বুঝলাম পরে।
স্বীকার করতে লজ্জা নেই যে, ভবিষ্যতে যে লোকালয়ে আমি পৌঁছেছিলাম সেখানকার যানবাহনদি বা পয়ঃপ্রণালী ইত্যাদি সম্বন্ধে খুব বেশি আমি জানতে পারিনি। জানাও সম্ভব নয়। আগামী কাল আর ইউটোপিয়া সম্বন্ধে অনেক বর্ণনা আপনারা পড়েছেন। লক্ষ লক্ষ বছরের ব্যবধান এক লাফে টপকে এমন এক সোনার যুগে গিয়ে পড়লাম, যেখানকার অভিনবত্ব আমাকে হকচকিয়ে তুলল। কাজেই স্বয়ংচালিত ব্যবস্থার একটা অস্পষ্ট ধারণা ছাড়া সে যুগ সম্বন্ধে আর কিছু আপনাদের শোনাতে পারব বলে মনে হয় না আমার।
যেমন ধরুন, অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্বন্ধে কিছুই জানতে পারিনি আমি। শ্মশান বা সমাধিস্তম্ভ জাতীয় কিছু চোখে পড়েনি। ভেবেছিলাম, দূরে কোথাও শ্মশান বা গোরস্থান নিশ্চয় আছে। কিন্তু সে ভাবনা ভাবতে গিয়ে আর একটা আশ্চর্য জিনিষ লক্ষ্য করে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। খুদে মানুষদের মধ্যে বয়স্ক বা অক্ষম একজনও ছিল না। সব মানুষের বয়সই প্রায় সমান, সমান তাদের স্বাস্থ্য আর সৌন্দর্য।