সেই অপরূপ সন্ধ্যায় এই দৃশ্য দেখে আমার বিজ্ঞানী বিচারবুদ্ধি-বিবেচনা যে সিদ্ধান্তে এল, তা সংক্ষেপে এই–
ক্ষীয়মাণ মানবজাতির মাঝে এসে দাঁড়িয়েছি আমি। চাহিদা থেকে সৃষ্টি শক্তির সুনিরাপত্তা জন্ম দেয় দুর্বলতার। যে সামাজিক ব্যবস্থাকে সুষ্ঠু করার প্রচেষ্টায় আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করছি, তার কুফল সেদিন উপলব্ধি করলাম। অযুত বছরের চেষ্টায় মানুষ জয় করেছে দুর্জয় প্রকৃতিকে, সমাজের শত সমস্যাকে। আর তাই অখণ্ড নিরাপত্তার মাঝে থেকে ধীরে ধীরে অনন্ত সুপ্তির কোলে ঢলে পড়েছে তাদের শক্তি, মেধা, উদ্যম।
চাষবাস, বাগান তৈরি আর পশুপালন তারা সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে। মানবজাতির প্রয়োজনে যেটুকু শুধু প্রয়োজন, তা ছাড়া বাদবাকি অদৃশ্য হয়ে গেছে ধরণির বুক থেকে। বাতাস দেখলাম মশকশূন্য, ছত্রাক বা আগাছার চিহ্ন কোথাও দেখলাম না। যেদিকে তাকাই শুধু সুন্দর ফুল, মিষ্টি আর ঝলমলে প্রজাপতি। ব্যাধি লোপ পেয়েছে চিরতরে। যে কদিন ছিলাম সেখানে, কোনও সংক্রামক রোগের সন্ধান পাইনি আমি। পচন আর ক্ষয় আর উদ্ৰব্যস্ত করে না মানুষকে।
সামাজিক ব্যবস্থার চরম উৎকর্ষ দেখলাম। জমকালো বাড়িতে ঝলমলে পোশাক-পরা ফটফটে নির্ঝঞ্ঝাট জীবনযাপন করছে, দৈনিক পরিশ্রমের কোনও বালাই নেই। সামাজিক বা অর্থনৈতিক কোনও সংগ্রামের চিহ্ন দেখলাম না। ব্যাবসা, বাণিজ্য, দোকানপাট, বিজ্ঞাপন ইত্যাদি কিছুই আর নেই। সে এক সামাজিক স্বর্গ।
প্রকৃতি বিজয় যে সম্পূর্ণ হয়েছে, আমার সে বিশ্বাস মানুষদের দৈহিক খবৰ্তা, তাদের ধীশক্তির অভাব আর বড় বড় প্রচুর ধ্বংসস্তূপ দেখে বদ্ধমূল হল। সংগ্রামের পরেই আসে প্রশান্তি। শক্তি, উদ্যম, মেধায় বলীয়ান হয়ে উঠেছিল মানবকুল, তাই তাদের অফুরন্ত প্রাণশক্তি নিয়োগ করলে জীবনধারণকে সহজ করে তোলার প্রচেষ্টায়। সফল হল তারা, কিন্তু তারপরেই শুরু হল তার প্রতিক্রিয়া।
অনাবিল স্বাচ্ছন্দ্য আর নিশ্চিন্ত নিরাপত্তা মানেই মানুষের চিরন্তন অশান্ত উদ্যমের পরিসমাপ্তি; অর্থাৎ যা আমাদের কাছে শক্তি, তা-ই এসে দাঁড়ায় দুর্বলতায়। লক্ষ লক্ষ বছর ধরে যুদ্ধবিগ্রহের ভয়াবহতা এদের স্পর্শ করেনি। বুনো জন্তু বা রোগের প্রকোপ যে মানুষের মহাশত্রু, তা-ও তারা জানেনি। দৈহিক পরিশ্রমের কোনও প্রয়োজন হয়নি। যে বিশাল প্রাসাদগুলো দেখলাম, সেগুলো পূর্ববর্তী সংগ্রামশীল মানবজাতি গঠন করে সূচনা করে গেছে অসীম শান্তিভরা শেষ পরিচ্ছেদের। তাই নিরাপত্তার সোনার খাঁচায় মৃত্যু হল উদ্যম শক্তির। এল সূক্ষ্ম শিল্পচর্চা।
কিন্তু তা-ও লোপ পাবে ধীরে ধীরে। খুদে মানুষদের মাঝে সেই চিহ্নই দেখলাম আমি। সূর্যের আলোয় নাচ, গান আর ফুলপ্রীতি ছাড়া নতুন কোনও শিল্পবোধই নেই তাদের মধ্যে। এ-ও একদিন ক্ষীণ হয়ে হারিয়ে যাবে পরিতৃপ্ত নিষ্ক্রিয়তার মাঝে। বেদনা আর চাহিদার জাঁতাকল-নিষ্পেষ থেকেই শিল্পচেতনার প্রকাশ। কাজেই যেখানে নেই ক্লেশ, অভাব, দুঃখ–সেখানে শিল্পের মৃত্যু তো স্বাভাবিক!
জনসংখ্যা বৃদ্ধিও রুদ্ধ হয়েছে। কিন্তু বিপরীত প্রতিক্রিয়া-সূত্র অনুসারে সংখ্যা আরও কমে আসছে। এত ধ্বংসস্তূপই তার প্রমাণ।
ঘনিয়ে-আসা আঁধারের মাঝে বসে জগতের এই আপাত অবিশ্বাস্য শেষ পরিণতির কথাই চিন্তা করলাম সেদিন।…
০৭. শঙ্কা
৭। শঙ্কা
মানুষের এই চরম বিজয়গৌরবের কথা ভাবছি, এমন সময়ে উত্তর-পূর্বের আকাশ রুপোর ধারায় ধুইয়ে দিয়ে উঠে এল দ্বাদশীর হলদেটে চাঁদ। নিচে খুদে মানুষের চলাফেরা আর দেখতে পেলাম না। মাথার ওপর দিয়ে নিঃশব্দে উড়ে গেল পেঁচাজাতীয় একটা নিশাচর পাখি। বেশ কনকনে ঠান্ডা অনুভব করলাম। এবার কোথাও ঘুমের আয়োজন করা দরকার। যে বাড়িটা আমি চিনি, সেটার খোঁজে তাকালাম নিচের দিকে। তখনই চাঁদের আলোয় ব্রোঞ্জের বেদির ওপর বসা সাদা স্ফিংক্স মূর্তিটা চোখে পড়ল। সিলভার বাৰ্চটাও নজর এড়াল না। ফ্যাকাশে আলোয় ছায়াকালো রডোডেনড্রনকুঞ্জও দেখতে পেলাম। আর দেখলাম ছোট লনটা। কিন্তু এইটাই কি সেই লন? না, কখনওই নয়।
কিন্তু সত্যিই এইটাই সেই লন। কেননা, স্ফিংক্স-এর কুষ্ঠরোগীর মতো সাদা মুখটা সেইদিকেই ফেরানো। আর সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ যখন আমার রইল না, তখন আমার যে কী মনের অবস্থা হল, তা আপনারা কল্পনা করতে পারবেন না। কেননা, লনের মধ্যে টাইম মেশিনের কোনও চিহ্নই দেখতে পেলাম না আমি!
যেন চাবুকের ঘায়ে ছিটকে দাঁড়িয়ে উঠলাম। টাইম মেশিন নেই, তার মানে ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফিরে যাওয়ার পথ হল বন্ধ। পরের মুহূর্তে ভয়ে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে পাগলের মতো ছুটে চললাম নিচের দিকে। একবার দারুণ আছাড় খেয়ে গভীরভাবে কেটে গেল মাথার কাছে, কিন্তু ভ্রূক্ষেপ না করে উঠে দাঁড়িয়েই আবার ছুটলাম ঊর্ধ্বশ্বাসে। গাল আর চিবুকের ওপর দিয়ে রক্তের উষ্ণধারা গড়িয়ে পড়তে লাগল, কিন্তু আমার খেয়াল নেই। প্রতিমুহূর্তে মনকে আশ্বাস দিলাম, ওরা হয়তো মেশিনটাকে চোখের সামনে থেকে ঝোপঝাড়ে সরিয়ে রেখেছে। কিন্তু তবুও ভয়ে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে এল আমার। ঝড়ের বেগে ছুটতে ছুটতে এই বয়সেও দুমাইল পথ দশ মিনিটের মধ্যে পেরিয়ে এসে পৌঁছালাম লনে। বারকয়েক সজোরে চিৎকার করে ডাকলাম ওদের, কিন্তু কারও সাড়াশব্দ পেলাম না।