সপ্তাহে পাঁচদিন বা ছয়দিন যে সে এই রুটিন ফলো করতো—তাও নয়। বড়জোর দুই কি তিন দিন। অনেক সময় ভালো একটা শিকার পেলে গোটা সপ্তাহই পায়ের উপর পা তুলে কাটিয়ে দিত। কাজেই, হ্যাংআউট করার জন্য তাদের হাতে ছিল অফুরন্ত সময়। আজ আমাদের হ্যাঙ্গাউট করার জন্য কতো প্ল্যান-প্রোগ্রাম করতে হয়। নিজের স্কেজিউল দেখতে হয়। বসের স্কেজিউল দেখতে হয়। তাদের এইসব স্কেজিউল দেখার প্যারা ছিল না। পরিবারের সবাই মিলে যখন খুশি যেখানে খুশি হ্যাং আউট করতে যেত। আগে থেকে বুকিং করারও ঝামেলা ছিল না।
দুর্ভিক্ষ বা অপুষ্টি কাকে বলে—তারা জানতো না। দুর্ভিক্ষ তো ক্ষিযুগের স্ষ্টি আর অপুষ্টি আধুনিক শিল্পযুগের। তাদের গড় আয়ু হয়তো খুব বেশি ছিল না। তিরিশ কি চল্লিশ বছর। তার কারণ অধিক শিশু ম্ত্যুহার। কিন্তু যারা অল্প বয়সে সারভাইভ করে যেতো, তারা ঠিকই বছর ষাটেক সুস্থ সবল বেঁচে থাকতো।
তাদের এই ভাল থাকার রহস্য ছিল তাদের বৈচিত্র্যময় খাবারের মেন্যু। আমাদের দেশে একজন ক্ষক যেখানে সকালের নাশ্তায় ভাত খান, দুপুরের লাঞ্চে ভাত খান এবং রাতের ডিনারেও ভাত খান, সেখানে এই মানুষেরা সকালে হয়তো খেতো আঙুর আর মাশরুম, দুপুরে কচ্ছপের ফ্রাই আর রাতে খরগোশের স্টীক। পরের দিন আবার মেন্যু বদলে যেতো। এই করে করে সব রকম পুষ্টিগুণ সম্দ্ধ খাবারই তাদের খাওয়া হয়ে যেতো।
পরবর্তীতে ক্ষিভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় মানুষ কোন একটা ফসলের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এতে একে তো সব রকম পুষ্টিগুণ সম্দ্ধ খাবারে ছেড়ে এক শর্করার দিকে ঝুঁকে পড়ায় মানবজাতির সামগ্রিক স্বাস্থ্য আগের তুলনায় খারাপ হয়ে পড়ে, তার উপর এক বছর ধান না হলে পুরো দেশে দুর্ভিক্ষ লেগে যেতো। শিকারী সমাজ এই দিকে দিয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। কোন একটা নির্দিষ্ট ফসলের উপর এদের নির্ভরশীলতা না থাকায় বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস—যাই হোক না কেন—এদের খাবার ম্যানেজ হয়ে যেত। আর কিছু না হোক, বার রকমের ফলমূল তো আছেই।
আমাদের যাবতীয় রোগবালাইয়ের জন্মও এই ক্ষি সমাজে এসে। যতো রকম সংক্রামক রোগ আছে—হাম, যক্ষ্মা, বসন্ত—সব কিছুর জীবাণু আমাদের এই গবাদি পশু থেকে পাওয়া। আরেকটা কারণ এমন—ক্ষি আর শিল্পভিত্তিক সমাজেই মানুষ অল্প জায়গায় অনেক মানুষ খুব ঘিঞ্জি পরিবেশে বাস করে। শিকারী সমাজে এর বালাই ছিল না। মানুষ ঘুরে ঘুরে বেড়াতো। কোন এক এলাকায় রোগের বিস্তার হলে সেই এলাকা ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতো। মহামারী বিস্ত্ত হবার চান্সই পেত না।
তাই বলে যে প্রাচীন মানুষের সব কিছুই যা ভালো ছিল—তা নয়। এই যে মহামারী বিস্ত্ত হবার চান্স পেত না, তার কারণ হচ্ছে সেই সমাজে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ফেলে সবাই অন্য কোথাও চলে যেত। ব্দ্ধদের অবস্থা তো ছিল আরো করুণ। ব্দ্ধ মাত্রই একটা দলের জন্য বোঝা। তো সেই বোঝা ঘাড় থেকে নামানোর জন্য তারা ব্দ্ধের কাঁধে কুড়োল দিয়ে আঘাত করে তাকে পরপারে পৌঁছে দিত। এই একটা দিকে আমরা আধুনিক মানুষ অনেক সভ্য হয়েছি বলা যায়। আমরা আমাদের ব্দ্ধ বাবা-মা কে কুড়োল দিয়ে আঘাত করে মেরে ফেলি না। বড়জোর ব্দ্ধাশ্রমে ফেলে আসি।
শিশু হত্যা তো ছিল অতি সাধারণ ঘটনা। অবশ্য শিশু হত্যার এই রেওয়াজ আমরা মধ্যযুগে আরবে আর তারও আগে গ্রীক সমাজে দেখেছি। শিশু জন্মগতভাবে দুর্বল বা ভগ্নস্বাস্থ্য হল এই শিশু সমাজের কোন কাজে আসবে না ভেবে তাকে হত্যা করতো। এই সেদিন পর্যন্ত প্যারাগুয়েতে আচে নামক এক জনগোষ্ঠী বাস করতো, যাদের জীবনধারা খুঁটিয়ে দেখলে প্রাচীন মানুষের জীবন আচরণের কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে। এরা এই আরব বা গ্রীকদের চেয়েও ছিল এক ধাপ এগিয়ে। শিশুর মাথায় চুল কম, তাকে মেরে ফেলো। শিশুটির চেহারা জোকার জোকার টাইপ—তাকে মেরে ফেলো। কিংবা দলে মেয়ে বেশি হয়ে গেছে। আর মেয়ের দরকার নাই। কাজেই, এই মেয়ে শিশুটিকে মেরে ফেলো।
আমাদের ডেফিনিশন অনুযায়ী এগুলো হিংস্রতা। ওদের ডিকশনারীতে হয়তো এগুলোকে হিংস্রতা ধরা হত না। আমরা যেমন অবলীলায় মানবশিশুর ভ্রূণ মেরে ফেলি, ওরাও ঠিক তেমনি অদরকারি মানব শিশু মেরে ফেলতো। আফটার অল, মানুষ তো। কিছু নির্বিকার হিংস্রতা আমাদের রক্তে, ইতিহাসে বেশ ভালোভাবেই আছে।
প্রথম ছবিটা ১২ থেকে ২০ হাজার বছর আগে আঁকা। ছবিটা পাওয়া গেছে ফ্রান্সের দক্ষিণে লাসকাউ নামের এক গুহায়।
ছবিটায় আমরা একজন মরা মানুষ দেখতে পাচ্ছি। বাইসনের আক্রমণে যার ম্ত্যু হয়েছে। মানুষটির মুখে পাখির আদল। কেন—আমরা জানি না। ম্ত্যুর পরও মানুষটির পুরুষাঙ্গ খাড়া হয়ে আছে। কেন—তাও আমরা জানি না। মানুষটির পাশেই আরেকটা পাখি দেখতে পাচ্ছি আমরা। স্কলাররা বলেন—এই পাখি আমাদের আত্নার প্রতীক। বাইসনের আক্রমণে মানুষটির ম্ত্যুর সঙ্গে সঙ্গে আত্নারূপী পাখিটি খাঁচা ছেড়ে পালিয়েছে।
কথা হচ্ছে—-শিকারী মানুষেরা কি সত্যিই এতো গভীর অর্থ ভেবে ছবিটি এঁকেছিল? না এগুলো আমাদের ইন্টেলিজেন্ট ইন্টেরপ্রিটেশনা? টাইম মেশিনে করে অতীতে যাওয়া ছাড়া এই রহস্য ভেদ করার আসলে কোন উপায় নেই।
পরের ছবিটা প্রায় ৯ হাজার বছর আগের। পাওয়া গেছে আর্জেন্টিনার এক গুহায়। তখনো মানুষ শিকারী দশা পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তবে মানুষ যে উন্নতি করছে—তার সমস্ত রকম লক্ষণ এই ছবিতে বিদ্যমান। এই ছবিকে বলা হয় শিকারী যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রকর্ম।