পার্টনারের ক্ষত্রেও ব্যাপারটা তাই। আপনি হয়তো সবার কাছে আপনার পার্টনারের হাজারটা বদনাম করে বেড়ান। কিন্তু অন্য কেউ আপনার পার্টনারকে সামান্য সময়ের জন্যও দখল করতে এলেও ঠিকই আবার বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়ান। এই যে পজেসিভনেস, এইটা আমাদের পূর্বপুরুষদের সময় থেকেই আমাদের রক্তে বাহিত হয়ে আসছে।
অনেকে বলেন, আজকের প্রযুক্তিনির্ভর সমাজে বিয়ে টিকে থাকার কথা না। এখনো যে টিকে আছে, তার কারণ বোধয় বহু বছরের এই অভ্যাস। নেক্সট টাইম আপনার পার্টনার যদি আপনাকে নিয়ে একটু পজেসিভ হয়ও, তাকে ভুল বুঝবেন না প্লিজ। সবই আমাদের পূর্বপুরুষদের পাপের ফসল।
শারীরিক দিক দিয়ে তো বটেই, স্রেফ মগজের দিক দিয়েও আমাদের শিকারী পূর্বপুরুষেরা আমাদের চেয়ে এগিয়ে ছিল। অন্তত তথ্য প্রমাণ তাই বলে। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য, গত তিরিশ হাজার বছরে আমাদের মগজের তেমন উন্নতি হয়নি। বরং কিছুটা অবনতি হয়েছে বলা যায়।
তাহলে এই যে আমাদের আধুনিক সভ্যতা, কম্পিউটার, ইন্টারনেট, স্পেসশিপ—এগুলো কার অবদান? কোন ভিনগ্রহী এসে তো এগুলো তৈরি করে দিয়ে যায়নি। এগুলো আমাদের মগজেরই অবদান। সত্যি করে বললে, আমাদের কালেক্টিভ মগজের। ইনডিভিজুয়াল মগজের সাইজ সত্যিই কমেছে।
প্রাচীন মানুষ ছিল ভয়াবহ লেভেলের জ্ঞানী। সারভাইভালের জন্যই তাদের জ্ঞানী না হয়ে উপায় ছিল না। আজ একজন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার জগৎ-সংসার, পাড়া-প্রতিবেশী সম্বন্ধে কিছু না জেনেই দিব্যি জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে। প্রাচীন মানুষের পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল না। নিজেদের এলাকার প্রতিটি ইঞ্চি সম্বন্ধে তাদের নিখুঁত জ্ঞান রাখতে হত। আমরা যেখানে গুগল ম্যাপ ছাড়া পাশের গলিতে ওয়ালমার্ট আছে কিনা, তাও বলতে পারি না।
খাবার সংগ্রহের কথাই ধরা যাক না কেন। কোন ফল কখন হয়, সেই জ্ঞান তো তাদের ছিলই, প্রতিবেশী বানর কিংবা হনুমানের দল এগজ্যাক্টলি কখন সেই ফলে আক্রমণ করে বসবে, সেই জ্ঞানও তাদের রাখতে হত। এইখানেই শেষ নয়। কোন ফল খেতে মজা, কোন ফলে বিষ আছে আর কোন ফল রোগবালাইয়ে ওষুধের কাজ দিবে—এই সব তাদের নখদর্পণে ছিল। এগুলো ছিল সেকালের সাধারণ জ্ঞান। প্রত্যেক ইনডিভিজুয়ালকে এই জ্ঞানটুকু রাখতে হত। কোন ডাক্তার-বৈদ্য যেহেতু ছিল না তাদের বলে দেবার জন্য কিংবা লিখিত ভাষাও চালু হয়নি যে ফলের গায়ে কোন নিঃস্বার্থ মানুষ এসে লিখে রাখবেঃ “সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণঃ এই ফলে বিষ আছে। এই ফল খাবেন না।”
পশু শিকারের জন্য তাদের প্রয়োজন হত হাতিয়ার। এই হাতিয়ারও ছিল হিজ হিজ হুজ হুজ। সেই সময় মানুষ তাই ব্যবহার করতো, যা সে নিজে তৈরি করতো। ধরা যাক দুই একটা হারপুন এবার। যে লোকটা হারপুন বানাতো, সেই ঐ হারপুন দিয়ে শিকার করতো। দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি ব্যবহার্যই তাই। ফলে কাঁচামাল সংগ্রহ থেকে শুরু করে গোটা ম্যানুফ্যাকচারিং প্রসেসের খুঁটিনাটি সে জানতো। আর ভালো শিকারের জন্য দরকার ভালো হারপুন। নিজের হারপুনকে সেরা শেপটা দেবার জন্য তাকে মগজ খাটাতেই হত।
আজ তার কুলাঙ্গার বংশধর কম্পিউটার ব্যবহার করে, সে কিন্তু কানে না, কম্পিউটার কীভাবে তৈরি হয়। কম্পিউটার কীভাবে কাজ করে–এটাও সে জানে না। অথচ সে মনের আনন্দে সে কম্পিউটারে চ্যাট করে চলেছে। এর নামই টেকনোলজি। যা আমাদের মাথা না খাটিয়ে সুবিধাটুকু পুরোপুরি উপভোগ করার সুযোগ এনে দেয়, তাই টেকনোলজি।
ক্যালকুলাস যেমন গণিতের একটা শাখা। কিন্তু ক্যালকুলাসের সুত্রগুলো আপনি না বুঝেও আপনার কাজে ব্যবহার করতে পারবেন। sinX কে ডিফারেনশিয়েট করলে cosX পাওয়া যায়। এটা আমরা সবাই জানি। কীভাবে পাওয়া যায়া—এটা না বুঝলেও কিন্তু আপনি পরীক্ষার খাতায় নম্বর পেয়ে যাচ্ছেন কিংবা ফিজিক্সের একটা থিওরি প্রমাণ করতে কাজে লাগাতে পারছেন। এই ক্ষেত্রে ক্যালকুলাস কিন্তু গণিত বা বিজ্ঞান নয়, ক্যালকুলাস একটা প্রযুক্তি।
প্রাচীন মানুষের কাছে হাতিয়ার ছিল, কিন্তু সেই অর্থে টেকনোলজি ছিল না। পেশাভিত্তিক শ্রেণীবিন্যাস তখনো তৈরি হয় নি যে কোন একজন দক্ষ ইঞ্জিনিয়ার দলের সব হারপুন তৈরি করবে। বাকি সবাই তা নিয়ে শিকারে বেরোবে। কাজেই, এখন আমরা একটা বস্তুর ফিজিক্স নিয়ে যতো গভীরভাবে চিন্তা করি, আমাদের পূর্বপুরুষেরা তার চেয়েও বেশি চিন্তা করতেন। চিন্তা করতে বাধ্য হতেন বলা যায়। ফলে, তাদের মগজের ব্যবহারও ছিল বেশি। আমরা যে দিন দিন আমাদের মগজের ব্যবহার কমিয়ে দিচ্ছি, তা নিয়ে কখনো ভেবেছি কি?
লাইফস্টাইলের দিক দিয়েও তারা আমাদের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে ছিলেন। আজ একজন কর্পোরেট মানুষের ঘুম ভাঙে সকাল সাতটায়। কোনোভাবে নাশতা করে তাকে অফিসের উদ্দেশ্যে দৌড়াতে হয়। তারপর আট কি দশ ঘণ্টা অমানুষিক খাটা খেটে রাতে বাসায় ফিরে আর কিছু করার এনার্জি থাকে না আসলে। তা বাচ্চাদের সাথে খেলাধুলাই হোক কিংবা স্ত্রীর সাথে।
অথচ ত্রিশ হাজার বছর আগে সেই একই মানুষটি সকাল নয়টা কি দশটায় হেলেদুলে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে বের হত। ফলমুল, মাশরুম সংগ্রহ করে দিন কাটাতো। মাঝেমধ্যে ভুল করে বাঘ মামার টেরিটোরিতে ঢুকে পড়েই আবার দৌড়ে পালাতো। চারটার দিকে বাসায় ফিরে পরিবারের সবাই মিলে রান্নাবান্না করতো। বাচ্চাদের সাথে খেলতো। বাঘ মামার হাত থেকে বেঁচে আসার গল্প শোনাতো।